রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনায় বিরোধীদের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও কর্মসূচি। প্রায় ৩০০ বিরোধী সাংসদের জমায়েতে রাজধানীর রাস্তায় বিশাল অভিযান। ঠিক সেই সময় তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অনুষ্ঠানে। শুধু উপস্থিত হওয়াই নয়, মোদির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বললেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন করেন তাঁকে, “ক্যায়া কল্যাণ জি, সব কল্যাণ হ্যায় তো?”। ইঙ্গিতপূর্ণ উত্তর দিলেন কল্যাণ, “হাঁ স্যার, আভি তক সবকুছ কল্যাণকর হ্যায়”। এরপর অনুষ্ঠান শেষে প্রধানমন্ত্রী নিজেই যখন মঞ্চের চেয়ার গোছাতে শুরু করলেন পাশে এসে হাত লাগালেন কল্যাণও। গ্রুপ ফটো তোলার সময় কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিজের পাশে ডেকে দাঁড় করালেন মোদি। সোমবারের এই ঘটনা কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়ে উসকে দিয়েছে নতুন জল্পনা।
কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে শ্রীরামপুরের চারবারের সাংসদ কল্যাণের আকচাআকচি নতুন নয়। কিছুদিন আগে নির্বাচন কমিশনে তৃণমূল সাংসদদের রাজ্য বিজেপির বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে যাওয়ার দিন দুজনের তিক্ততা চরমে ওঠে। প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে প্রায় ঝগড়া শুরু করে দেন। মহুয়া শেষ পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্ব থাকা সিআরপিএফ জওয়ানদের বলেন, কল্যাণকে গ্রেফতার করতে। তারপর থেকেই নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে মহুয়ার বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন কল্যাণ। তিনি আশা করেছিলেন এই ব্যাপারে তৃণমূল নেত্রী তাঁর পাশে থাকবেন। কিন্তু ঘটে বিপরীত। তৃণমূল সাংসদদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভার্চুয়াল বৈঠকে উল্টে তাঁকেই সমালোচনা করা হয় এবং সংযত থাকতে বলা হয়। সেদিনই দলের লোকসভার চিফ হুইপ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন তিনি।
সামাজিক মাধ্যমে তিনি লেখেন, “সম্প্রতি একটি পাবলিক পডকাস্টে মহুয়া মৈত্র আমার সম্পর্কে যে ব্যক্তিগত মন্তব্য করেছেন, তা আমি লক্ষ করেছি। একজন সহ-সাংসদকে ‘শুয়োর’ বলে তুলনা করা শুধু দুঃখজনকই নয়, এটি সভ্য আলোচনার মৌলিক শর্তগুলির প্রতি গভীর অবজ্ঞা প্রকাশ করে।”
লোকসভায় দীর্ঘদিন ধরে দলের অবস্থান তুলে ধরার পাশাপাশি রাজ্য সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মামলায় কলকাতা হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত আইনজীবী হিসেবে সওয়াল করেন কল্যাণ। তাঁর অভিমান, দল তাঁর অবদানকে উপেক্ষা করেছে এবং মহুয়া মৈত্র বারবার তাঁকে অপমান করলেও নেতৃত্ব নীরব থেকেছে। মহুয়ার বিরুদ্ধে দলীয় নেতৃত্ব কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় তিনি যে ব্যথিত, সেই কথাও সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন তিনি।
প্রকাশ্যে দুই সাংসদের কাদা ছোড়াছুড়ি আটকাতে শেষ পর্যন্ত আসরে নামেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। চিফ হুইপ পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ার দিন অভিষেক নিজে ফোন করেন কল্যাণকে। জানান, দুদিন বাদে তিনি দিল্লি যাবেন, নিজে আলাদা করে কল্যাণের সঙ্গে কথা বলবেন এই বিষয়ে।
কিন্তু সেদিনের ভার্চুয়াল বৈঠকে অসুস্থ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জায়গায় অভিষেককে লোকসভার দলনেতা করার সিদ্ধান্ত নেয় তৃণমূল। পাশাপাশি কল্যাণের চিফ হুইপের কাজ দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কাকলি ঘোষ দস্তিদারকে। এরপর অভিষেক দিল্লি এলেও কল্যাণ তাঁর সঙ্গে আর দেখা করেননি। উপস্থিত থাকছেন না সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে তৃণমূল সাংসদদের প্রতিদিনের বিক্ষোভ কর্মসূচিতেও।
দলের সঙ্গে কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দূরত্ব যে তৈরি হয়েছে সেটা পরিষ্কার। তাই নিয়ে কোনও জল্পনা ছিল না। জল্পনার সূত্রপাত হল সোমবার। বিরোধীদের নির্বাচন কমিশন ঘেরাও অভিযানে যোগ না দিয়ে তিনি বাড়িতে বসে থাকতে পারতেন, বা সংসদের অধিবেশনে যোগ দিতে পারতেন। কিন্তু তা না করে তিনি চলে গেলেন বাবা খড়ক সিং মার্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাংসদদের জন্য বহুতল আবাসন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে। গেলেন, মোদির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বললেন, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন। দীর্ঘ সময় ধরে সংসদে মোদিকে নিজের বক্তৃতায় বহুবার তুলোধোনা করেছেন শ্রীরামপুরের সাংসদ। আজ সেই মোদির সঙ্গে কল্যাণের হৃদ্যতামূলক বার্তালাপ ও আচরণ কি ভবিষ্যতে নতুন কোনও সম্পর্ক বা সমীকরণের ইঙ্গিত দিচ্ছে না?