দিব্যেন্দু ঘোষ
এপার বাংলা না ওপার বাংলা, ঘটি না বাঙাল, ইলিশ ভাল না চিংড়ি, লোটা না মাচা, সব ছাপিয়ে শুধু আবেগ ভেসে থাকে। ভাসিয়ে রাখতে হয়। বাংলা-বাঙালির রক্তে মিশে থাকে যে দ্বৈরথ, তা তো আবেগের সুতো দিয়েই বোনা। সে আবেগ কী করে বুঝবে স্পেন, কী করেই বা বুঝবেন মোলিনা বা ব্রুঁজো? তিকিতাকা নয়, ডার্বি মানে ময়দানের সবুজ ঘাস, কান্না সুখ, অভিমান, প্রেমে লেপ্টে থাকা একরাশ ইচ্ছে। রক্তে, সত্তায় জমে থাকা জেদ। লাল-হলুদ এবং সবুজ-মেরুনের লড়াই বড় মিষ্টি। এ লড়াই চলুক। যে লড়াই মানুষকে আনন্দ দেয়, যে লড়াই ভালবাসতে শেখায়, সেই লড়াই থাকুক।
জন্ম জন্মান্তরের প্রতিদ্বন্দ্বিতা,
স্লোগান পাল্টা স্লোগান,
গ্যালারিতে তর্জন-গর্জন,
মাঠে ৯০ মিনিটের আগুন—
এই সবই আমাদের ফুটবলের প্রাণ।
ঐতিহ্যে, গর্বে টগবগে ফুটবল।
এই মিষ্টি লড়াই চলুক…
এই রঙিন শত্রুতা বজায় থাকুক…
কারণ তোমার অস্তিত্বেই তো আমাদের উত্তেজনা, আমাদের চিরন্তন ডার্বির মাহাত্ম্য। ফুটবল বাঁচুক, ময়দান বাঁচুক, বাংলা বাঁচুক।
সকাল থেকেই পাড়ায় পাড়ায় তারস্বরে বাজছে, সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল, কিংবদন্তি মান্না দের সেই কালজয়ী গান। এর চেয়ে বড় সত্যি যে আর কিছু নেই। বাঙালির ফুটবল-প্রেম চরমে উঠেছে। কথায় বলে ‘বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ’। বাংলার মানুষ যে সারা বছর ধরে তেরো রকমের উৎসবে মেতে থাকে, তা বোঝাতেই এই প্রবাদ। তবে প্রবাদটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক নয়। কারণ, এই ডার্বিও বাঙালির আরেক উৎসব। তাই সেই প্রবাদে তেরো পার্বণ না বলে চোদ্দ পার্বণ বললে অত্যুক্তি হয় না।
‘ঘটি’দের ক্লাব মোহনবাগান, ‘বাঙাল’দের ক্লাব ইস্টবেঙ্গল। তাই এই দুই ক্লাবের ফুটবল-যুদ্ধ মানে ঘটি-বাঙালেরও লড়াই। তাই এই দুই ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ আদতে দুই শ্রেণির বাঙালির মান-সম্মান, আবেগ ও আত্মাভিমানের দ্বৈরথ। এমন বহু পরিবার রয়েছে, যেখানে একই ছাদের তলায় দুই ক্লাবেরই সমর্থক থাকেন। ‘ঘটি’ পরিবারে জন্ম নিয়েও লাল-হলুদ সমর্থক বা ‘বাঙাল’ হয়েও সে সবুজ-মেরুনের দলে, এমনও দেখা যায়। এই অবস্থায় কলকাতা ডার্বি মানেই বহু পরিবারে গৃহযুদ্ধ অবধারিত। দুই ক্লাবই শতাব্দীপ্রাচীন হলেও বয়সের দিক থেকে ইস্টবেঙ্গলের চেয়ে এগিয়ে মোহনবাগান ক্লাব। ১৮৮৯ সালে জন্ম মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাবের। উত্তর কলকাতার মোহনবাগান অঞ্চলের মিত্র ও সেন পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ভূপেন্দ্রনাথ বসু ১৮৮৯-এ এই ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে এই ক্লাবের অবদান রয়েছে বলে স্বীকার করেন ইতিহাসবিদরা। ১৯১১ সালে আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগানের ফুটবলাররা খালি পায়ে খেলে বুট পরে খেলা ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে হারিয়ে হইচই ফেলে দেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের এই জয়কেই স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ধরা হয়। বলা হয়, ওই জয়ের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে ও তার পর থেকেই ভারতবাসীর মনে হতে শুরু করে, নানা বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ফুটবল মাঠে ইংরেজদের হারানো সম্ভব হলে স্বাধীনতা আন্দোলেনেও সফল হওয়া সম্ভব।
ইস্টবেঙ্গলের জন্ম ১৯২০-তে। কথিত আছে, ইস্টবেঙ্গলের জন্মের পিছনেও মোহনবাগানের পরোক্ষ অবদান রয়েছে। কোচবিহার কাপের ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল মোহনবাগান ক্লাব ও কলকাতার আরেক প্রাচীন প্রতিষ্ঠান জোড়াবাগান ক্লাব। সেই ফাইনালে জিতেছিল মোহনবাগান। শোনা যায়, ওই ম্যাচে ‘পূর্ববঙ্গীয়’ হিসেবে পরিচিত শৈলেশ বসুকে মাঠে নামতে না দেওয়ায় জোড়াবাগান ক্লাবের সহ সভাপতি সুরেশচন্দ্র চৌধুরী, যিনি নিজেও ‘পূর্ববঙ্গীয়’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন, তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে পদত্যাগ করেন এবং সেই অঞ্চলের মানুষদের নিয়ে এক নতুন সংগঠন গড়ে তোলেন, যার নাম দেন ইস্টবেঙ্গল। নতুন এই ক্লাবের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সুরেশচন্দ্র ছাড়াও ছিলেন রাজা মন্মথনাথ চৌধুরী, রমেশচন্দ্র (নশা) সেন ও অরবিন্দ ঘোষ। বঙ্গভঙ্গের আগে ও পরে এই ক্লাবের জনপ্রিয়তা দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৯২১-এর ৮ অগাস্ট কোচবিহার কাপে প্রথম মুখোমুখি হয় এই দুই ক্লাব। বিশ্ব ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা এই কলকাতা ডার্বিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাব দ্বৈরথ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং এল ক্লাসিকো (বার্সেলোনা বনাম রিয়াল মাদ্রিদ), নর্থ-ওয়েস্ট ডার্বি (ম্যাঞ্চেস্টার বনাম লিভারপুল), ওল্ড ফার্ম ডার্বি (রেঞ্জার্স বনাম সেলটিক) ও সুপার ক্লাসিকোর (রিভারপ্লেট বনাম বোকা জুনিয়র্স) মতো ফুটবলের বিশ্বখ্যাত চিরপ্রতিদ্বন্দ্বিতার সঙ্গে একই আসনে বসিয়েছে। আজও যে বাংলার চতুর্দশ পার্বণ, ডার্বি উৎসব। বাঙালির আবেগ, আনন্দ-হতাশা, আশা-নিরাশা জড়িয়ে থাকে যার সঙ্গে।
ইস্টবেঙ্গলের জন্মলগ্ন থেকেই তাদের সঙ্গে মোহনবাগানের চিরশত্রুতা, যার বীজ পোঁতা চিরকালীন বাঙাল-ঘটি দ্বন্দ্বে। তবে দুই ক্লাবের সমর্থকদেরই বুকে আবেগটা আছে, তাই ঝগড়াও আছে। স্বামী-স্ত্রীর নিত্য ঝগড়ার মতো। ময়দানে দুই দলের সমর্থকদের একে অপরকে বিভিন্ন ভাবে বিদ্রুপ করার চল বহু যুগ ধরেই চলে আসছে। সেটা কখনও শালীন, কখনও আবার শালীনতার মাত্রা ছাড়ায়। সালটা ২০১৫। ভারত ও বাংলার মানুষ প্রথম দেখল একটি ময়দানি কেরামতি। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ডার্বি ম্যাচের দিন একটি নতুন বস্তু ভারতীয় ফুটবলে আবিভূর্ত হল, ‘টিফো’। সেই টিফোতে লেখা ছিল, ‘চা চিনি দুধে…’। কথাটা এমনিতে বড্ড সাদামাটা হলেও যাঁরা নিয়মিত ময়দানে যান, তাঁদের কাছে বড্ড চেনা এবং দুই দলের সমর্থকদের কাছেই অশালীন সম্বোধন। তবে খেলার মাঠ এমন একটা তীর্থ যেখানে জাত, ধর্ম, বর্ণ, রং সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। ফুটবলপ্রেমীদের যাঁর যা-ই রাজনৈতিক বিশ্বাস থাকুক, তা সরিয়ে রেখেই প্রিয় দলের হয়ে গলা ফাটান। রোনাল্ডো কোন দেশের প্লেয়ার তা একবাক্যে বলে দেবেন প্রায় সকলেই, কিন্তু এর পর সেই দেশের প্রেসিডেন্টের নাম জিজ্ঞাসা করলে মাথা চুলকোবেন। এটাই ফুটবল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের এই চিরশত্রুতাই ডার্বির ঝাঁঝ বাড়িয়ে দেয়, এত মজা! ঘটিরা যেমন চিরকাল বাঙাল বাহিনীকে ‘কাঁটাতার’ বা ‘খুঁটি পোঁতা কাঙাল’-এর মতো বাছাই সম্বোধনে খোঁটা দিয়ে গিয়েছে, উল্টো শিবির থেকেও উড়ে এসেছে ‘ফুটো ঘটি’র মতো সুভাষণী। লেখার অযোগ্য ময়দানি গালিগালাজ তো আছেই। এখন দুই দলেই বাঙাল-ঘটি দূরে থাক, ক’টা বাঙালি আছে তা এক হাতে গুণে ফেলা যাবে। কিন্তু সমর্থকদের বুকে আবেগটা আছে, তাই ঝগড়াও আছে। স্বামী-স্ত্রীর নিত্য ঝগড়ার মতো। ঝগড়া না হলে সব পানসে।
সেই ময়দান, ওই ছায়াঘেরা অঞ্চলটা তখন যেন হাত-পা বিছিয়ে রেখেছে আরও অনেকটা জায়গা জুড়ে। ধর্মতলা চত্বরে তখনও ট্রামডিপোর চারপাশে সবুজ ছেঁটে বাসের আস্তানা বানানো হয়নি। এসপ্ল্যানেড ম্যানশনের উল্টোদিক থেকে জলা জমিগুলো গিয়ে মিশে গেছে সবুজে, সেই খুঁটিপোতা ময়দানের স্যাঁতস্যাঁতে রোমান্টিসিজমের ভেতর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ। ধূসর কলকাতার অফিসপাড়াকে কেমন আগলে রাখা মায়ের মতো কলকাতা ময়দান। একটু শীতের চাদর মুড়লেই জালের ভেতর পিচে রোলার টানছে মালি, জল ছড়াচ্ছে কেউ, নিস্তব্ধতার ভেতর চলছে শহর কলকাতার ফুসফুসে প্রাণ প্রতিষ্ঠার কাজ। পোর্ট ট্রাস্ট, আরিয়ান, উয়ারি থেকে ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগান। সার বাঁধা পরপর ক্লাব, ইডেনের আলোর তলায় তখন বাঙালির একমাত্র আবেগ ফুটবল। কলকাতার দুভাগ হয়ে যাওয়া বড় ম্যাচের দিন।
ইংরেজ আমলে তৈরি ময়দানের মালিক এখন ভারতীয় সেনা। তিন প্রধানের তখন মাঠ ঘেরার কাজ শেষ হয়েছে। কাঠের গ্যালারি। মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল তাঁবুর একটা দিক খোলা, ওই দিকে কাঁটাতারের বেড়া আর জংলা অঞ্চল গিয়ে মিশেছে পাশের মাঠের সঙ্গে। পঞ্চাশের দশকে ইস্টবেঙ্গলে খেলছেন আপ্পারাও-আহমেদের পঞ্চপাণ্ডব। এদিকে মোহনবাগানেও আস্তে আস্তে আসছেন চুণী-শৈলেন মান্না খেলছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপে। বড়ো ম্যাচের দিন সমর্থক-আবেগের নমুনার গল্প মিশে আছে ময়দানের মাটির তলায় তলায়। ম্যাচের দিন সকাল গোষ্ঠপাল আর লেসলির মুখ থেকে বিক্রি হত বড় বড় ব্যাটারির খোল আর কার্ডবোর্ডের তৈরি টেলিস্কোপ। তখন রেডিও যুগ আসছে। ট্রানজিস্টারের ভাঙা কমেন্ট্রিতেই দুলে উঠছে একটা জাতি। আড়াআড়ি দু’ভাগ গোটা বাংলা। যারা টিকিট পেতেন না তাদের সম্বল হত ওই টেলিস্কোপ আর ব্যাটারির খোল। এ-জিনিস পাওয়া যেত ভাড়াতেও, দুটি মিলে দু’ঘণ্টার ভাড়া আট আনা। খোলের ওপর ডানহাত চেপে টেলিস্কোপে চোখ রেখেই চলত বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। একদিক খোলা অঞ্চলের দখলের জন্য রীতিমতো মারামারি দেখা দিত বড় ম্যাচের দুপুর থেকে। দুই প্রধানের মাঠে খেলা থাকলে একটা বড়ো অঞ্চলজুড়ে থাকত সারে সারে সাইকেল, তার ওপর উঠে লোক দাঁড়িয়ে যেত গোলের চিৎকার শুনে। গিজগিজে মাথার ভিড়ে ম্যাচে চোখ রাখা বাইরে থেকে অসম্ভব। ইস্টবেঙ্গল মাঠে বড়ো ম্যাচ থাকলে গাছের মাথায় জায়গা নিতে হত দুপুর থেকেই।
গোষ্ঠ পাল মোহনবাগান গ্যালারিতে বসতে চাইতেন না ব্রিটিশদের তৈরি বলে। মোহন সচিব ধীরেন দে বড়ো ম্যাচের দিন গোষ্ঠ পাল সরণির ছায়াও মাড়াতেন না। ম্যাচের ৭০ মিনিট বসে থাকতেন বাবুঘাটের একটা নৌকায়। এক অমোঘ বিশ্বাস যে, ক্লাবে ম্যাচের দিন তিনি ঢুকলেই নাকি ইস্টবেঙ্গল তাদের হারিয়ে দেবে। নিজের ড্রাইভারকে বারে বারে দৌড় করিয়ে জেনে নিতেন স্কোরকার্ড। তখন কলকাতায় কংক্রিটের জঙ্গল হয়নি, তাই মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে গোল হলে চিৎকার স্পষ্ট হত শান্ত বাবুঘাটেও। ইস্টবেঙ্গলের প্রয়াত সচিব পল্টু দাশ গ্যালারিতে একটি নির্দিষ্ট চেয়ার রেখেছিলেন নিজের। ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে মুখ করে থাকতেন মোহনবাগান আক্রমণে এলে। আর গোটা ম্যাচ একবারও ওই সিটের সামনে থেকে নড়তেন না। ইস্টবেঙ্গলের এই তুকতাক আরও মজার হয়ে ওঠে সাবেক কর্তা স্বপন বলের আমলে। স্বপন বল ডার্বির দিন দুটো চেয়ার বা বেঞ্চি পাশাপাশি দিয়ে মাঝের জোড়া অংশটায় বসতেন। ওই ছিল বিশ্বাস- ময়দানের চেনা বড় ম্যাচের তুকতাক। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের মাঝামাঝি অবধিও মাঠে আসতেন না মেয়েরা। বড় ম্যাচের দিন প্রথম শোভাবাজার রাজবাড়ি, দত্ত বাড়ি, সেনবাড়ির মহিলাদের একবার দেখা গেল মোহনবাগান গ্যালারিতে। সেই প্রথম মেয়েদের আনাগোনা শুরু হল ময়দানে। বড় ম্যাচের উন্মাদনা মাঠমুখী করল তাঁদেরও। ডার্বি ম্যাচ দেখেছিল রোম্যান্টিসিজমও। বদ্রু ব্যানার্জি বড়ো ম্যাচের দিন মাঠে আনতেন তাঁর প্রেমিকা বিখ্যাত অভিনেত্রী তপতী ঘোষকে। দল গোল করলে গ্যালারিতে হাত নাড়াতেন বদ্রু-তপতী! ময়দানের গরম চায়ের পেয়ালায় চলকে যাওয়া সোনালি প্রেমের দিন তখন… আস্তে আস্তে কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলি হয়ে অজ পাড়াগাঁয়ে বড়ো ম্যাচের দিন ভিড় জমতে শুরু করল পাড়ার ক্লাবে রেডিওটার সামনে। জগুবাবুর বাজার থেকে স্পেশাল অর্ডারে ইলিশ আর কোলে মার্কেট অঞ্চল থেকে আসত গলদা চিংড়ি। ম্যাচের সময় দুই গ্যালারিতে তাঁদের প্রিয় মাছের আগমন ছিল ডার্বির বিশেষ আকর্ষণ। কাঠের পাটাতন করে নিচে বাঁশের পায়া বেঁধে ঝুলিয়ে দেওয়া হত ইলিশ বা চিংড়ি। গোল হলেই উত্তাল হত সেই কাঠামোটা, উত্তাল হত গ্যালারি…
কিন্তু এই বড় ম্যাচের উন্মাদনা, তা কি আজও একই রকম? সত্তরোর্ধ্বদের গলায় ঝরে পড়ে আলগা বিষণ্ণতা। সেই আবেগ আর কই? এখন তো সবই বিদেশি আর বাইরের স্টেটের ছেলে ভর্তি। বাঙালি আর কটা আছে! তবু বড় ম্যাচের আগের রাতে আজও ঘুম আসে না শহর কলকাতার। মাঠমুখী জনতার ভিড়ে ডার্বি আজও যেন কোথাও দুহাত মেলে ডাকে এক শতাব্দীপ্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মতো, যেখানে খেলা-সমাজ-রাজনীতি-রোম্যান্টিসজম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। আবার একটা বড়ো ম্যাচ, আবার একটা জাতির দুভাগ হয়ে যাবার দিন। একটা প্রাচীন জাতির ভরকেন্দ্রে থাকা কোনো দলিল আজ পাতা উল্টে চলে যাবে পরের অধ্যায়ে। কোনো দস্তাবেজের ভেতর হাসবেন ধীরেন দে থেকে জ্যোতিষ গুহ, চুণী গোস্বামী থেকে আহমেদ খান। এখানেই বাঙালির বৃহত্তম সংস্কৃতির চলমান ইতিহাস থমকে দাঁড়ায় ৯০ মিনিট, লেখা হয় নতুন অধ্যায়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা যে শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরে অবিরাম সময়ের স্রোতে ভেসে চলা বাঙালির একটুকরো প্রাণের আরাম…