ধারে ভারে অনেক এগিয়ে মোহনবাগান। পজিশন ধরে ধরে তুল্যমূল্য বিচারে মোহনবাগানই সেরা। দেশের সেরা অ্যাটাকিং লাইন আপ। দেশের অন্যতম সেরা গোলকিপার মোহনবাগানের তিন কাঠির নীচে। এর মধ্যে দ্বিরুক্তি নেই। থাকতে পারে না। তবুও হারতে হল মোলিনার দলকে। কেন? ডার্বি মানে, সব সমীকরণ ধুয়েমুছে দিয়ে সেদিন নার্ভ যাদের শক্ত, তারাই করবে বাজিমাত। ডুরান্ড ডার্বিতে গোটা নব্বই মিনিট মোহনবাগানের থেকে বেটার খেলল ইস্টবেঙ্গল। তাই জিত। দুটো গোল হয়ে যাওয়ার পর কিছুটা ডিফেন্সিভ খেলতে শুরু করতেই মোহনবাগান ব্যবধান কমায়। লাল-হলুদ ব্রিগেড আক্রমণটা ধরে রাখলে আরও বেশি গোলে জিততে পারত। সেই ঝলক প্রতি মুহূর্তে দেখেছে যুবভারতী।
নিজেদের গুছিয়ে নিতে খুব বেশি সময় পায়নি মোহনবাগান। সেদিক থেকে ইস্টবেঙ্গল যে মরসুমের শুরুতে বেশ তৈরি, তা বোঝা গেল ডুরান্ড কাপের কোয়ার্টার ফাইনালে। প্রথম থেকেই পরিষ্কার, চোটের জন্য রাইট উইংয়ে ভুগতে হবে মোহনবাগানকে। মনবীর, সালাউদ্দিন, কিয়ান আনসারি না থাকায় চাপ পড়ল পাসাং দর্জি তামাংয়ের ওপর। মোলিনার চমক বুমেরাং হয়ে গেল। প্রথমার্ধেই তাঁকে প্রায় বোতলবন্দি করে ফেলেন লালচুংনুঙ্গা। প্রয়োজনে আনোয়ার আলিও আসছিলেন সাহায্য করতে। আশিস রাইও সাহায্য করতে পারেনি পাসাংকে। গোটা দলটাকে দেখে পুরোপুরি ফিট মনে হয়নি। তা না হলে ওভাবে কেউ পেনাল্টির সুযোগ দেয়? বিপিন সিং আদায় করে নিলেন পেনাল্টি। দিয়ামানতাকোস ভুল করেননি। বিশাল কাইথ পৌঁছতে পারেননি। তবে পুরোপুরি বল বিপিনের নিয়ন্ত্রণে না থাকায়, সুযোগ ছিল আশিসের সামনে। তবে একটু তাড়াহুড়ো করে দলকে সমস্যায় ফেলে দেন তিনি। মোহনবাগান ডিফেন্ডার টম অলড্রেডের ভুলে দ্বিতীয় গোল। ঠিক সময়ে ট্যাকেল করতে পারলেন না। গত মরসুমে ভাল ছন্দে ছিলেন না দিয়ামানতাকোস। তবে এই মরসুমে শুরু থেকেই ছন্দে। ডার্বিতে জোড়া গোল করে জাত চেনালেন গ্রিক স্ট্রাইকার।
ফিটনেস মোহনবাগানকে বড় সমস্যায় ফেলে দিল। স্বীকারও করে নিয়েছেন কোচ হোসে মোলিনা। পরিষ্কার জানিয়েছিলেন, মাত্র দেড় সপ্তাহের প্রি সিজনে এমন ম্যাচ খেলা কঠিন। মোহনবাগান ফুটবলারদের প্রায় দেখাই গেল না। মস্তিস্কের লড়াইয়ে টেক্কা দিলেন অস্কার ব্রুঁজো। রশিদ না থাকায়, পাঁচ মিডফিল্ডার নামিয়ে দিয়েছিলেন অস্কার। দেদার ফাউল করে মোহনবাগান মিডফিল্ডারদের খেলা তৈরিই করতে দেননি। একচেটিয়া আধিপত্য রেখে ম্যাচ বের করে নিয়ে চলে গেলেন ব্রুঁজো ব্রিগেড। দ্বিতীয়ার্ধে কিছু সময় মোহনবাগান লড়লেও কাজের কাজ হয়নি। এখনও বড় ম্যাচের ধকল সহ্য করার জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত হতে পারেনি মোহনবাগান, সেটা স্পষ্ট হয়ে গেল। রক্ষণ এবং মাঝমাঠের মধ্যে ফাঁকফোঁকর প্রকট হয়ে উঠল। ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নামার আগে সেভাবে কঠিন দলের বিরুদ্ধে পরীক্ষিতও হয়নি সবুজ-মেরুন শিবির। দ্বিতীয়ার্ধে কামিন্স এবং ম্যাকলারেন নামার পর খানিকটা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে সবুজ-মেরুন। কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত হল না। বেশিরভাগ ফুটবলার ঠিক করে বল রিসিভটাও করতে পারছিলেন না। সে তুলনায় অনেক সাবলীল দেখিয়েছে ইস্টবেঙ্গলকে। চেষ্টাটা ইস্টবেঙ্গলেরই বেশি ছিল।
ডুরান্ডে এ পর্যন্ত দুর্দান্ত খেলছিলেন লিস্টন কোলাসো। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে নিস্প্রভ দেখাল দেশের সেরা উইঙ্গারকে। ডবল কভারিংয়ে মোহনবাগানের সেরা অস্ত্রকে আটকে দিল ইস্টবেঙ্গল। অন্যদিকে নবাগত পাসাং দরজিকে নড়তেই দেননি দেশের অন্যতম সেরা সাইড ব্যাক লালনুংচুঙ্গা। ফলে মোহনবাগানের দুই উইংই অচল হয়ে গেল। যার ফলে প্রভাবহীন মনে হল ম্যাকলারেনের মতো দুরন্ত স্ট্রাইকারকেও। তবে টিমগেমে প্রায় নিখুঁত পারফরম্যান্স না করলে ইস্টবেঙ্গলের পক্ষে জেতা কঠিন হত। শুরু থেকে আক্রমণ। নিজেদের মধ্যে সমন্বয় রক্ষা। মোহনবাগানের দুর্বলতাগুলি কাজে লাগানো। ব্রুঁজোর নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি, গেমপ্ল্যান। দিয়ামানতাকোসকে সঠিকভাবে ব্যবহার করে দিনের শেষে শেষ হাসি হাসলেন। যে ক্ষিপ্রতায় দ্বিতীয় গোলটি করলেন গ্রিক ফরোয়ার্ড, তা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। অবাক লাগল, যেখানে ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে মিগুয়েলের মতো টাচ ফুটবলার, নিখুঁত পাস বাড়ান হামেশাই, সেখানে কোনও ব্লকার নামালেন না মোলিনা। আপুইয়া এবং থাপা দুজনেই আক্রমনাত্মক মেজাজের। ফলে বাড়তি চাপে পড়ে গেল মোহনবাগান রক্ষণ।
গত বার ইস্টবেঙ্গলের দলে অনেক ফাঁক ছিল। তা ভরাট করতে পেরেছেন ব্রুজ়ো। রক্ষণে হিজাজি মাহেরের বদলে এনেছেন কেভিন সিবিয়েকে। আনোয়ার আলির সঙ্গে সিবিয়ের জুটি ভাল দেখাচ্ছে। এই ম্যাচে জেমি ম্যাকলারেনকে নড়তে দেননি তাঁরা। দ্বিতীয়ার্ধে বাগানের আক্রমণের চাপ সামলেছেন। গোললাইন সেভ করেছেন সিবিয়ে। মিগুয়েল ফিগুয়েরার মতো বিদেশি দলে এসেছেন। আবার বিপিন সিং ও এডমুন্ড লালরিনডিকার মতো দু’জন ভাল ভারতীয় উইঙ্গার দুরন্ত খেলছেন। লাল-হলুদের বেশি আক্রমণ হল দুই প্রান্ত ধরে। ধরতেই পারলেন না মোলিনা। ফল পেল ইস্টবেঙ্গল হাতেনাতে। ফুটবলে মাঝমাঠের দখল যার কাছে থাকে, ম্যাচ জেতার সম্ভাবনা তার বেশি। এটা সহজ সত্য। সেটাই করে দেখিয়েছে ইস্টবেঙ্গল। প্রতিপক্ষ মোহনবাগানের মাঝমাঠ তারকাখচিত। জাতীয় দলে খেলা লিস্টন কোলাসো, সাহাল আবদুল সামাদ, অনিরুদ্ধ থাপা, আপুইয়া। তাঁদেরই মাটি ধরালেন ব্রুজ়ো। ইস্টবেঙ্গলের মাঝমাঠে মিগুয়েল, সাউল ক্রেসপো, শৌভিক চক্রবর্তীরা নিজেদের মধ্যে ছোট ছোট পাসে আক্রমণে উঠলেন। চাপে পড়ে বাগানের মাঝমাঠের ফুটবলারদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হল। ফলে বোঝাপড়া ঠিকমতো হচ্ছিল না। ফলে মোহনবাগানের আক্রমণ দানা বাঁধল না। শুরু থেকেই আক্রমণ করে মোহনবাগানকে চাপে ফেল দিল লাল-হলুদ। প্রথম মিনিটেই বাগানের গোলে শট লালরিনডিকার। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। মনোভাব স্পষ্ট, আজ জেতার জন্যই মাঠে নেমেছে লাল-হলুদ ব্রিগেড। দ্বিতীয়ার্ধে ৬৫ মিনিটের আগে আক্রমণের ঝাঁজ বেশি ছিল ইস্টবেঙ্গলের। সেখানেই পিছিয়ে পড়ে মোহনবাগান। দ্বিতীয়ার্ধে আবার ৮০ মিনিটের পর আক্রমণে ওঠে ইস্টবেঙ্গল। এই আক্রমণাত্মক ফুটবল কাজে লাগল। ৬০ মিনিটের পর একসঙ্গে তিন পরিবর্তন করেন মোলিনা। ফলে বাগান আক্রমণ থেকে গোল তুলে আনে। সেটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে খেলার গতি কমিয়ে দেন ব্রুজ়ো। সময় নষ্ট করতে থাকেন লাল-হলুদ ফুটবলারেরা। তাতে বাগান যে ছন্দ পেয়ে গিয়েছিল তা নষ্ট হয়। তার পর প্রয়োজন অনুযায়ী বদল করেন ব্রুজ়োও। মোলিনার চাল নষ্ট করে দেন।
বারবার বোঝা যাচ্ছিল, লাল-হলুদ ফুটবলারদের মধ্যে একটা জেতার তাগিদ তৈরি করতে পেরেছেন ব্রুজ়ো।
Leave a comment
Leave a comment