দিব্যেন্দু ঘোষ
রাজভবনের বিশালত্ব, আভিজাত্য, পরিচ্ছন্ন দালানকোটায় পিছলে যাচ্ছে ঝাড়বাতির রোশনাই, চোখের সামনে দেখছি, সেই বিরাটত্বের কাছে ছোট্ট মেয়েটা মুখচোরা তো নয়ই, যেন আরও বহুত্ব নিয়ে খিলখিলিয়ে উঠছে, গলায় ব্রোঞ্জ মেডেলটা ঝোলানো, হাতে ধরা রাজ্যপালের হাত থেকে সবে পাওয়া মেমেন্টো, সার্টিফিকেট, পরনে ট্র্যাক সুট, পায়ে স্নিকার, ছিপছিপে, ঝকঝকে, উজ্জ্বলতর মুখে যেন খই ফুটছে ঠোঁটে। তার আন্তর্জাতিক সাফল্যের আলো খেলা করে বেড়াচ্ছে রাজভবন জুড়ে, রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার পর তার জেদ যেনও আরও চওড়া হচ্ছে, দেখছি, ডায়াসের আলো আরও গভীর হচ্ছে, চমত্কারিত্ব ছড়িয়ে যাচ্ছে অতিথি, অভ্যাগতদের মধ্যে। ছোট্ট মেয়েটার সাফল্য এবং রাজ্যপালের হাত থেকে পুরস্কার নিমেষে ভিজিয়ে দিল বাবা শাশ্বত চক্রবর্তীর চোখ। এ তো আনন্দাশ্রু, পরক্ষণেই মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন।
এ গল্প ইধা চক্রবর্তীর। বয়স মাত্র বারো। এ কাহিনি গলি থেকে রাজপথে উত্তরণের। এ কাহিনি বর্ধমান থেকে শ্রীলঙ্কা, সার্বিয়ায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতে নেওয়ার। লড়াইটা একা ইধার নয়, জুড়ে আছেন অনেকে। মা ইন্দিরা চক্রবর্তী, বাবা শাশ্বত চক্রবর্তী, তার স্কুল ইন্দাস ভ্যালি ওয়ার্ল্ড স্কুল, ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি বৈকুণ্ঠ সিং এবং ইধার দুই কোচ সিহান সত্যজিত বড়ুয়া ও সেনসেই অগ্নিকি বড়ুয়া। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই ক্যারাটেতে হাতেখড়ি। মায়ের নিরন্তর উত্সাহ, কোচেদের পরিশ্রম ইধাকে ক্ষুরধার করেছে। শুধু হাত পা ছু়ড়ে বেড়ানোই নয়, পড়াশোনাতেও গভীর মনোযোগ গ্রেড এইটের ইধার।
রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোসের কাছে খবর পৌঁছে যায় সার্বিয়ায় ইধার নজরকাড়া সাফল্যের পরেই। ডেকে পাঠান রাজভবনে। বাবা ও কোচকে নিয়ে হাজির ইধা। পুরস্কৃত করতে চান তিনি, জানিয়ে দেন আনন্দ বোস। তারপরেই সোমবারের বর্ণময় অনুষ্ঠান বাসরে ইধার ওপর হাজার আলোর ঝলকানি, মুহুর্মুহু ঝলসে উঠছে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট। লাজুক নয়, বরং ইধার চোখমুখ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে স্মার্টনেস। মাত্র কয়েক হাত দূরে বসে দেখছি, তৈরি হচ্ছে এক নিপাট বাঙালি-কন্যার দুর্ধর্ষ গল্প। বিশ্বমঞ্চে বাংলার গর্ব, সার্বিয়ায় ব্রোঞ্জ জিতে ইতিহাসের পাতায় বর্ধমানের ইধা চক্রবর্তী। চলতি বছরের এপ্রিলে ‘ওয়ার্ল্ড স্কুল কমব্যাট গেমস ২০২৫’-এ অনূর্ধ্ব-১৫ বিভাগের ক্যারাটে প্রতিযোগিতায় দুর্দান্ত পারফরম্যান্স। বিশ্বের ২২টি দেশের ৪৪ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে অদম্য লড়াই শেষে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে ইধা। ‘ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’র প্রতিনিধি হিসেবে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক আসরে অংশ নিয়েই নজরকাড়া সাফল্য। সাহস, দক্ষতা ও আত্মবিশ্বাসের মেলবন্ধন। আজ দেশের গর্ব ইধা। গোটা দেশের ক্রীড়া জগতের কাছে সে এখন এক অনুপ্রেরণার নাম। ইধা এই প্রসঙ্গে জানিয়েছে, আমি খুবই খুশি এবং আনন্দিত। তবে আমার কোচেরা সাহায্য না করলে এই সাফল্য আসত না।ইধার এই সাফল্যে আনন্দে ভাসছে তার পরিবার। তার বাবা শাশ্বত চক্রবর্তী, পেশায় একজন ব্যবসায়ী, তিনিও মেয়ের এই কৃতিত্বে ভীষণ গর্বিত। পরিবারের সদস্যদের মতে, ইধার এই সাফল্য হঠাৎ করে আসেনি। এর পেছনে রয়েছে তার দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম, আত্মনিবেদন ও অধ্যবসায়। আন্তর্জাতিক ক্রীড়ামঞ্চে বাংলার মেয়ের উজ্জ্বল উপস্থিতি। ছোটবেলা থেকেই ক্যারাটের প্রতি প্রবল আগ্রহ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই আগ্রহ পরিণত হয়েছে অধ্যবসায় ও জেদে।
গত বছর সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় ব্রোঞ্জ পেয়েছিল ইধা। চলতি বছরে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে ‘ক্যারাটে অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’ আয়োজিত প্রতিযোগিতায় সোনা জেতে ইধা। সেই সুবাদেই আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয় সে। তার পরেই সার্বিয়ায় এই দুরন্ত সফলতা। ২০২৩ থেকে বিভিন্ন জেলা, রাজ্য ও জাতীয় স্তরের টুর্নামেন্টে পঁচিশটি সোনা, আটটি রুপো জিতেছে ইধা। ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে হওয়া ইন্ট ইন্ডিয়া কাই কাপে কাতায় সোনা এবং কুমিতে-তে রুপো জেতে। ইধার প্রথম সোনা তেইশে আসানসোলে অল বেঙ্গল স্টেট ক্যারাটে চ্যাম্পিয়নশিপে। তার পর থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। জিতটাকে অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছে ছোট্ট ইধা। এই বয়সে ইধার আন্তর্জাতিক জয় রাজ্যের উঠতি প্রতিভাদের কাছে এখন নতুন অনুপ্রেরণা। বিশ্বমঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করে জয় ছিনিয়ে আনার এই কাহিনি আগামী প্রজন্মকে পথ দেখাবে।
ইধার সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প করে রাজভবনের নিস্তব্ধ লাল কার্পেট বেছানো সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছি, ইধা তখন সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছে, অনেকটা ওপরে, রাজভবনের বিস্তীর্ণ প্রান্তর তখন উচ্চকিত ইধার সাফল্যের হুল্লোড়ে।