লাদাখের চ্যাংথাংয়ে সাড়ে ৫ হাজার মিটারের ওপর উচ্চতার কোরজোক ফু অভিযানে গিয়েছিলেন এভারেস্টজয়ী পর্বতারোহী দেবাশিস বিশ্বাস। পর্বতারোহণের পাশাপাশি ওই অঞ্চলের মাটি, জল, আবহাওয়া নিয়ে গবেষণা চালান। সেখানে পৌঁছে দেবাশিস ৬ হাজার মিটার উচ্চতার একটি অনামী পর্বত শৃঙ্গে আরোহণ করেন। সেই শৃঙ্গটি গত বছর নৃশংসভাবে খুন হয়ে যাওয়া মহিলা ডাক্তারের নামে উৎসর্গ করেছেন দেবাশিস। নাম দিয়েছেন ‘মাউন্ট অভয়া’।
কোরজোক ফু অঞ্চলের মাটি, জল, বাতাস, গ্লেসিয়ার নিয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে পর্বতারোহী ও গবেষক মিলিয়ে ১১ সদস্যের দল নিয়ে দেবাশিসরা কলকাতা থেকে রওনা হন ২৬ জুলাই। দেবাশিসের উদ্দেশ্য ছিল কোরজোক ফু-তে বহু অনামী শৃঙ্গের কোনও একটিতে আরোহণ করে গত বছর ৯ আগস্ট খুন হয়ে যাওয়া হতভাগ্য মহিলা ডাক্তারের নামে সেই শৃঙ্গটার নামকরণ করার। কোরজোক ফু-তে পৌঁছে দুটো দলে ভাগ হয়ে যান তাঁরা। গবেষকরা জল, মাটি, আবহাওয়া নিয়ে কাজ শুরু করেন। পর্বতারোহীর দল কোরজোক ফু-কে বেস ক্যাম্প বানান। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত শৃঙ্গ মেনটক কাঙ্গরি। কোরজক ফু থেকে বেস ক্যাম্প তুলে নিয়ে যান ১ নম্বর। সেখান থেকে ৪ আগস্ট আরোহণ করেন মেনটক কাঙ্গরি ওয়ান। সেই শৃঙ্গে আরোহণ করার পর দেবশিস সরে আসেন একটু পশ্চিম দিকে। ওখানে সেরোসো অঞ্চলে চিহ্নিত করেন একটি অনামী শৃঙ্গকে। আরোহণের রাস্তা খুঁজে বের করার পর ৭ আগস্ট অনামী শৃঙ্গের পেছন দিক থেকে ওঠার চেষ্টা করেন। খুব দুর্গম ছিল সেই পথ। বাকি সাথীদের বেসক্যাম্পে ফিরে যেতে বলে নিজে আরোহণের চেষ্টা চালান দেবাশিস। হার মানেননি হতভাগ্য ডাক্তার অভয়ার কথা স্মরণ করে। দুবৃত্তের হাতে ধর্ষিত ও খুন হওয়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল অভয়াকে। তাহলে তিনিই বা কেন পারবেন না। সেই জেদ থেকেই ৭ আগস্ট বেলা ১টায় শৃঙ্গে উঠে হাতে ভারতের তেরঙ্গা পতাকা নিয়ে ‘অভয়া’কে স্মরণ করে এর নাম রাখেন ‘মাউন্ট অভয়া’। আর এটাই দেবাশিসের জীবনের প্রথম ট্রাভার্স ক্লাইম্ব। মানে হল, পাহাড়ের এক ঢাল দিয়ে উঠে অন্যদিকের ঢাল দিয়ে নেমে আসা। এর আগে এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্ঘা সহ অনেক দুর্গম, জীবনসংশয়কারী শৃঙ্গে আরোহণ করেন দেবাশিস। সেখানে অভয়া শৃঙ্গে আরোহণের তৃপ্তি ও অনুভূতি ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। অভয়ার জীবন তো আর ফিরিয়ে দিতে পারবেন না, বিচারও পাইয়ে দিতে পারবেন না, কিন্তু তার কথা স্মরণ করে তার একটা পরিচিতি পাহাড়ের কোলে রেখে যেতে পারছেন, এটা ভেবেই ভাল লেগেছে দেবাশিসের। পরদিন ৮ আগস্ট চোরদৌল নামে একটি শৃঙ্গে আরোহণ করে ক্যাম্প গুটিয়ে ফিরে আসেন কোরজোক ফু-তে।
কলকাতা ফিরে ২০ আগস্ট রাতের দিকে ‘অভয়া’র বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে সদ্য শেষ করে আসা অভিযানের কথা জানান দেবাশিস। তাঁদের হতভাগ্য ডাক্তার মেয়ের নামে শৃঙ্গের নামকরণ ‘অভয়া’ রেখেছেন জেনে খুব খুশি হন। তাঁরা চেয়েছেন, অভয়া নামে এই শৃঙ্গের পরিচিতি না হয়ে অভয়ার আসল নামে এই নাম রাখা হোক। তাহলে বিশ্বের মানুষের কাছে অভয়ার আসল ঘটনা ও পরিচয় থাকবে চিরকাল। গোটা বিষয়টা বিচারাধীন। তাছাড়া নাম দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কিছু নিয়মকানুন আছে। চিঠি চাপাটি করার। সেটা অনেক দীর্ঘমেয়াদী ব্যাপার। তাছাড়া অভয়ার আসল নামে সেটা করা যাবে কিনা, তা নিয়েও সংশয় থাকছে।
ওই শৃঙ্গ থেকে দুটো পাথর আনেন দেবাশিস। দিয়ে আসেন অভয়ার বাবা-মাকে। বাড়িতে অভয়ার ছবির নীচে পাথরদুটো সাজিয়ে রেখেছেন হতভাগ্য ডাক্তারের বাবা-মা।
দেবাশিস বলেছেন, অভিযান সার্থক। ওখানকার জল, মাটি, বাতাস সংক্রান্ত গবেষণা করেছেন। ওখানে সোকার বলে একটা হ্রদ আছে। সেখানে আশেপাশে নুন জমে থাকতে দেখেছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন ওই জল নোনা হবে, কিন্তু মুখে দিয়ে দেখেছেন, মিষ্টি। অথচ একটু দূরেই থাকা সোমোরিরি হ্রদের টলটলে জল ওপর থেকে দেখলে মনে হবে মিষ্টি, কিন্তু মুখে দিলে বোঝা যাবে নোনতা। এর ফলে ওই হ্রদে মাছ বা অন্য জীব বিশেষ নেই। অথচ সোকার হ্রদে ঠিক এর উল্টো। গবেষকেদের বক্তব্য, সোকার হ্রদে এমন কোনও অ্যালগি বা অন্য কোনও উদ্ভিদ আছে, যারা নুনটা খেয়ে হ্রদের জলের মিষ্টতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেবাশিসদের এই গবেষণা নিয়ে লে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ও স্থানীয় প্রশাসন খুব আগ্রহী। স্থানীয় যে ২০ থেকে ২৫ জনের পাহাড়ি পরিবার আছে, তারা খুব সহযোগিতা করেছে এই অভিযানে। লে বিশ্ববিদ্যলয়ের শিক্ষার্থীরাও চায় এই অভিযানে অংশ নিতে, গবেষণায় কাজে লাগতে।
দেবাশিস চান কোরজোক ফু-র অল্পসংখ্যক অধিবাসীর সুস্থ জীবনযাপনের জন্য পাকা টয়লেটের ব্যবস্থা করার। কারণ ওরা এখনও খোলা বিস্তীর্ণ প্রান্তরকে টয়লেট হিসেবে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। টয়লেট তৈরি করে দিলে, সেই অভ্যাস ওরা ত্যাগ করবে, পরিবেশ আরও স্বচ্ছ রাখার স্বার্থে। আর এই মানুষগুলোর জীবনযাপন চলে ভেড়া, ইয়াকের দুধ থেকে মাখন, পনির বের করা জ্যারিকেনের মধ্যে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে। যদি ওদের জন্য একটা ছোট সাইজের মাখন বা পনির তৈরির মেশিনের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তাহলে ওদের জীবনযাত্রা আরও মসৃণ হবে। সমৃদ্ধিও আসবে ধীরে ধীরে।