গত জুন মাসে নরওয়ে ওপেনে প্রথমবার ক্লাসিক্যাল দাবায় বিশ্বের এক নম্বর ম্যাগনাস কার্লসেনকে হারিয়েছেন ভারতের ডি গুকেশ। এই ম্যাচ হারের পর হতাশায় টেবিলে ঘুসি মেরেছিলেন ৩৪ বছর বয়সী নরওয়েজিয়ান কিংবদন্তি। যে স্মৃতি টাটকা এখনও। এ ছাড়া গত ২০২৪ সালে কার্লসেনকে নরওয়ে দাবায় পরাস্ত করেছিলেন তরুণ প্রজ্ঞানন্দও। তবে বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ুর বিরুদ্ধে দুই ভারতীয়ের দুটি জয়ই ছিল সাদা ঘুঁটি নিয়ে।
কার্লসেনের বিরুদ্ধে গত ১৪ বছরে কালো ঘুঁটি নিয়ে জয় পেয়েছেন কেবলমাত্র একজন ভারতীয়ই। কিন্তু সেই ঐতিহাসিক জয়গাথা নিয়ে হয় না কোনও আলোচনা। এমনকী সেই ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টারের নামটাই জানা নেই অনেকের।
গত ২০১১ সালে বিশ্বনাথন আনন্দের কাছ থেকে পুনরুদ্ধার করার পর থেকে টানা ১৪ বছর ধরে বিশ্বের এক নম্বরে ম্যাগনাস কার্লসেন। এই ১৪ বছরে একমাত্র ভারতীয় হিসেবে যিনি কার্লসেনকে কালো ঘুঁটি দিয়ে হারিয়েছেন, তিনি আনন্দ নন। এমনকী গুকেশ বা প্রজ্ঞানন্দও নন। তিনি হলেন তাঞ্জাভুরে জন্মগ্রহণকারী কার্তিকেয়ন মুরলি। এই ভারতীয় গ্র্যান্ডমাস্টার গত ২০২৩ সালের কাতার মাস্টার্সে পেন্টাল হরিকৃষ্ণ এবং আনন্দের পর তৃতীয় ভারতীয় হিসেবে ক্লাসিক্যাল দাবায় ম্যাগনাস কার্লসেনকে একাধিকবার পরাজিত করার ইতিহাস গড়েছিলেন। তবে তার থেকেও বড় কথা হল, কার্লসেনের ১৪ বছরের রাজত্বে বিশ্বের এক নম্বর দাবাড়ুকে ক্লাসিক্যাল দাবায় কালো ঘুঁটি দিয়ে কিস্তিমাত করার কীর্তি গড়েন একমাত্র তিনিই।
ক্রিকেটের মুরলি অর্থাৎ মুথাইয়া মুরলিধরনকে একডাকে চেনে গোটা বিশ্ব। শ্রীলঙ্কার অফস্পিনার টেস্ট ক্রিকেটে গড়েছেন ৮০০ উইকেট নেওয়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে একাধিক রেস জেতার পাশাপাশি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফর্মুলা ওয়ানে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে গত ২০১০ সালে পদ্মশ্রী পেয়েছেন নারায়ণ কার্তিকেয়ন। অথচ দুয়ের সম্মিলিত নামের অধিকারী কার্তিকেয়ন মুরলি দাবার দুনিয়ায় অবিস্মরণীয় এক কীর্তি গড়েও থেকে গিয়েছেন একজন উপেক্ষিত নায়ক হিসেবেই। যদিও সম্প্রতি আবারও চর্চায় তিনি। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোমন্থন করেছেন কালো ঘুঁটি নিয়ে বিশ্বের এক নম্বরকে হারানোর স্মৃতি। সেই সঙ্গে এও জানিয়েছেন, কী করে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি।
দাবায় সাদা ঘুঁটি সর্বদাই আগে চলে। ফলে সাদা ঘুঁটি নিয়ে খেলা দাবাড়ুরা স্বভাবতই বাড়তি সুবিধা পেয়ে থাকেন খেলার গতি নিয়ন্ত্রণে। তাই কালো ঘুঁটি নিয়ে জেতাটা যে কোনও সময়েই স্পেশাল। ২৬ বছরের মুরলিও সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে জানান, “কালো ঘুঁটি দিয়ে বিশ্বের এক নম্বরকে হারানোর অনুভূতিটা ছিল অসাধারণ।” যদিও এর পাশাপাশি তিনি এও স্বীকার করে নিয়েছেন যে, কার্লসেনকে হারানোর সময় তিনি সত্যিই স্নায়ুর চাপ অনুভব করেছিলেন। তাঁর কথায়, “অবশ্যই একটা ভয় ছিল। তিনি বিশ্বের এক নম্বর খেলোয়াড়। আমি নার্ভাস এবং উত্তেজিত ছিলাম। তবে আমি তাঁর চালে কিছু দুর্বলতা লক্ষ করেছিলাম। যেটা ফলপ্রসূ হয়েছে। তাঁর প্রতি আমার অগাধ শ্রদ্ধা রয়েছে। তিনি আমার আদর্শ এবং সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা। বর্তমানে উন্নত কম্পিউটার প্রযুক্তি সত্ত্বেও তিনি সকলকে ছাপিয়ে যান। এটি সত্যিই এক শিক্ষণীয় বিষয়।”
১০ বছর বয়সে খেলা শুরু করা মুরলি দু’বারের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। ১২ বছর বয়সে তিনি প্রথমবার পেশাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। মজার বিষয় হল, দাবায় যে কেরিয়ার গড়বেন এমনটাই মোটেই এক সময় ভাবেননি। অতীতের একটি ঘটনার স্মৃতিচারণ করে মুরলি বলেন, “বলা যেতে পারে, এটি দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেছিল। আমার বাবার একটি অস্ত্রোপচার হয়েছিল। তিনি ১৫ দিন ধরে শয্যাশায়ী ছিলেন। এ সময় তিনি চেকার, দাবা, ক্যারামের মতো খেলাগুলি খেলতেন। আর আমিও অন্যান্য খেলার চেয়ে দাবার প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে উঠি। এভাবেই শুরু হয়েছিল। তারপর আমি একটি অ্যাকাডেমিতে যোগ দিই এবং এভাবেই চলতে থাকে।” সম্প্রতি চেন্নাই গ্র্যান্ড মাস্টার্সে যুগ্মভাবে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছেন তাঞ্জাভুরের মুরলি। তবে কাতারের রাতের কথা বলা হলে আজও বাকি সবকিছু ভুলে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে তাঁর দু’চোখ। তিনি বলেন, “ওটা আমার জন্য খুব স্পেশাল ছিল।”