রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
১৯৮০-র দশক, পাকিস্তানের কাহুটা। একটি ছেঁড়া চাদর, ধুলোমাখা রাস্তা, আর এক অচেনা মানুষ, যার দিকে কেউ নজর দিচ্ছিল না। তিনি আর কেউ নন, ভারতের ভবিষ্যৎ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা (NSA) অজিত ডোভাল। পাকিস্তানের ইসলামাবাদে গোপন অভিযান তিনি এভাবেই চালিয়েছিলেন এক ভিখারির ছদ্মবেশে।
চোখে পড়ার মতো কিছু ছিল না। কেবল সিকি আধুলি চাইতে চাইতে এদিক-ওদিক ঘোরাফেরা করা এক ভবঘুরে। কিন্তু ছেঁড়া চাদরের আড়ালে লুকিয়ে ছিল তীক্ষ্ণ মেধা। ইতিমধ্যেই সিকিম অভিযানে ও গোয়েন্দা ব্যুরো (IB)-তে সাহসী ভূমিকার জন্য খ্যাত, এবার তাঁর মিশন ছিল আরও বড়, পাকিস্তানের গোপন পরমাণু কর্মসূচি সম্পর্কে অকাট্য প্রমাণ জোগাড় করা।
১৯৭৪ সালে ভারতের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষার পর পাকিস্তান মরিয়া হয়ে ওঠে নিজস্ব পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে। চিনের মতো দেশের সাহায্য নিয়ে ইসলামাবাদ গড়ে তোলে গোপন পরমাণু প্রকল্প, যার কেন্দ্র ছিল কাহুটাতে, খান রিসার্চ ল্যাবরেটরিজ (KRL)। এই জায়গা ছিল কঠোর নিরাপত্তাবেষ্টিত। বিজ্ঞানী, নিরাপত্তাকর্মী ও সরকারি কর্মকর্তারা এখানে অত্যন্ত গোপনে এবং কঠোর রুটিনে চলাফেরা করতেন।
অজিত ডোভাল মাসের পর মাস ওই অঞ্চলে প্রায় অদৃশ্য হয়ে মিশে গেলেন। প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস, রাস্তাঘাটের চলাচল, এমনকি বাজারের অচেনা আলাপচারিতাও তিনি নোট নেওয়ার সুযোগ না পেলে নিজের মনে গেঁথে নিতেন।
অবশেষে তাঁর হাতে আসে বহুকাঙ্ক্ষিত সেই প্রমাণ। কাহুটার এক ছোট্ট সেলুনে প্রায়ই আসতেন গবেষকরা। তাঁদের চুল কেটে ফেলার পর মেঝেতে পড়ে থাকা চুল অন্য কেউ গুরুত্ব দিত না। কিন্তু ডোভাল গবেষকদের পড়ে থাকা চুলের ছোট ছোট টুকরো নিঃশব্দে সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিলেন ভারতে।
পরীক্ষার ফলাফল ছিল চমকপ্রদ। সেই চুলে পাওয়া গেল ইউরেনিয়ামের চিহ্ন ও তেজস্ক্রিয়তার উপস্থিতি। এতে নিশ্চিত হয়ে যায় ভারতের আশঙ্কা, পাকিস্তান গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে। এই তথ্য ভারতের কৌশলগত নিরাপত্তা পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এই অভিযান স্বল্পমেয়াদি ছিল না। প্রায় ছয় বছর ধরে অপরিসীম ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানে ছিলেন ডোভাল। একবার পরিচয় ফাঁস হলে তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত ছিল এবং ভারতের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারত। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাঁর এই প্রচেষ্টার ফলে পাকিস্তানের পরমাণু পরীক্ষার পরিকল্পনা অন্তত ১৫ বছর পিছিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল ভারত।
অজিত ডোভালের এই অভিযান আজও ভারতের গোয়েন্দা ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর অধ্যায় হিসেবে স্মরণীয়।