প্রথমবারের মতো নিলামে উঠছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে লেখা এবং স্বাক্ষরিত একটি বিরল চিঠি। ১৯২১ সালের ২৯ অক্টোবর লেখা এই চিঠিটি দার্শনিক শিশির কুমার মৈত্রকে উদ্দেশ্য করে লেখা হয়েছিল, যিনি তখন দার্জিলিংয়ের লোইস’ জুবিলি স্যানিটেরিয়াম-এ চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিঠিটি এখনও তার মূল খাম, শান্তিনিকেতন পোস্টমার্ক এবং ১ আনা সবুজ ভারতীয় ডাকটিকিটসহ সংরক্ষিত আছে।
রবীন্দ্রনাথ এই চিঠিতে মৈত্রর লেখা তাঁর দর্শন বিষয়ে প্রবন্ধের প্রশংসা করেছেন। একইসঙ্গে ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে নিজের অসন্তোষও ব্যক্ত করেছেন। তিনি ব্রিটিশ পাঠকদের “অ্যান ইনসুলার রেস” বা সংকীর্ণ মানসিকতার জাতি বলে মন্তব্য করেন। রবীন্দ্রনাথ জানান, তাঁর লেখাকে ইংরেজরা সহজে গ্রহণ করতে চায় না, বরং “যতটা সম্ভব বিদেশি ভাব কেটে দিলে তবেই তারা বুঝতে ও গ্রহণ করতে পারে।” এজন্য ইংরেজি অনুবাদের বদলে তিনি তাঁর লেখা জার্মান ভাষায় প্রকাশের প্রতি আগ্রহ দেখান।
চিঠিতে তিনি লিখেছেন, “অনেকেই আমার লেখা নিয়ে লিখেছেন বা বলেছেন, কিন্তু এমন স্পষ্টতা এবং সংক্ষিপ্ততায় কেউই ধরতে পারেননি। আপনার প্রবন্ধ আমার এক সাম্প্রতিক প্রাতিষ্ঠানিক নথির সঙ্গে বেশ মিল রয়েছে, সেটিও আমি আপনাকে পাঠাব।”
এই চিঠির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এটি লেখা হয়েছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের কয়েক সপ্তাহ আগে। ১৯২১ সালের ৭ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর সূচনা হয়। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ এই প্রতিষ্ঠানকে একটি বিশ্বমুখী ও দেশজ শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার চিন্তাভাবনায় গভীরভাবে ব্যস্ত ছিলেন। তাই এই চিঠি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি, দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সাংস্কৃতিক পরিকল্পনার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে উঠেছে।
চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ সি. এফ. অ্যান্ড্রুজের কথাও উল্লেখ করেছেন। তিনি মৈত্রর ইংরেজি লেখা পূর্ব আফ্রিকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ মজার ছলে লেখেন, অ্যান্ড্রুজ ইংরেজ মানসিকতার প্রতিনিধি হিসেবেই হয়তো সেটিকে তেমন গুরুত্ব দেননি। এখানেও তিনি ব্রিটিশ পাঠকদের সীমাবদ্ধ মনোভাব নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এই চিঠি আগামী ২৯ ও ৩০ আগস্ট AstaGuru Manifest Auction-এ নিলামে উঠবে। অনুমান করা হচ্ছে এর দাম উঠতে পারে **১০ লক্ষ থেকে ১২ লক্ষ টাকার মধ্যে।
রবীন্দ্র-গবেষক পবিত্র সরকার এই চিঠিকে “ঐতিহাসিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল” বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, “চিঠিটি অবশ্যই সযত্নে সংরক্ষণ করতে হবে, বিশ্বভারতীরও একটি কপি থাকা প্রয়োজন।”
শিশির কুমার মৈত্র ছিলেন বিশিষ্ট দার্শনিক। তিনি শ্রীঅরবিন্দের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক দর্শনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করেছেন এবং পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে ভারতীয় ভাবনাকে যুক্ত করেছেন। তিনি হেনরি বার্গসঁ, উইলিয়াম জেমস, আলফ্রেড নর্থ হোয়াইটহেড প্রমুখ পাশ্চাত্য চিন্তকের ভাবনাকে ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে সংযুক্ত করেছিলেন। তাঁর চিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন তাঁর বাবা। তিনি ছিলেন ঢাকা, প্রেসিডেন্সি ও রেভেনশ কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক এবং রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী।
পরে মৈত্র বারাণসী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রধান এবং আর্টস অনুষদের ডিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আধুনিক ভারতে দর্শনচর্চাকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে তাঁর অবদান ছিল বিশেষ। ভারতীয় ও পাশ্চাত্য চিন্তার মধ্যে সেতুবন্ধন ঘটানোই ছিল তাঁর আজীবন সাধনা।
AstaGuru–র ক্লায়েন্ট রিলেশনস ডিরেক্টর সানি চন্দিরামানি বলেন, “এই চিঠি শুধু ব্যক্তিগত বা দার্শনিক বিনিময় নয়, বরং এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের দলিল। যখন রবীন্দ্রনাথ কবি ও চিন্তক থেকে প্রতিষ্ঠান নির্মাতা হয়ে উঠছিলেন, তখনকার তাঁর মানসিকতা ও পরিকল্পনার নিখুঁত প্রতিফলন মেলে এই লেখায়।”