দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি
নিঃশব্দে চলে গেল আরও একটি বছর। ৩০ আগস্ট শনিবার ছিল বীর বিপ্লবী শহিদ কানাইলাল দত্তের জন্মদিন। যাঁদের আত্ম বলিদানের মধ্য দিয়ে আজ আমরা স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করছি তাঁদেরকেই কি আজ আমরা ভুলতে বসেছি? কিছুদিন আগেই সারা ভারতবর্ষ জুড়ে 'আজাদি কা অমৃত মহোৎসব' পালন করা হয়েছে। আর সেই মহোৎসব পালনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক নেতা নেত্রীরাও নানা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। অথচ যাঁদের বলিদানের জন্য আজ আমরা স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছি সেই বীর বিপ্লবীদের এত সহজে ভুলে যাওয়াকে সাধারণ মানুষ কখনও মানতে পারছেন না।
সম্প্রতি চন্দননগর পুরনিগমের পক্ষ থেকে সরিষা পাড়ায় শহিদ কানাইলাল দত্তর ঐতিহাসিক বাড়িকে বিপজ্জনক বাড়ি আখ্যা দিয়ে ভেঙে ফেলার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসকে সংরক্ষণ না করে উল্টে ইতিহাসকে মুছে ফেলার উদ্যোগ? এই পদক্ষেপকে মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না চন্দননগরবাসী।
চন্দননগরের মানুষ বলছেন বিপ্লবী কানাইলালের বাড়ি চন্দননগরের গর্ব। তাঁদের দাবি এই চন্দননগরের বুকে একসময় ফরাসি আমলের বহু স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য প্রশাসন উদ্যোগ নিয়েছে। অথচ চন্দননগরের ভূমিপুত্র বীর শহিদ কানাইলাল দত্ত কেন আজ তাদের কাছে ব্রাত্য হয়ে গেলেন তা তাঁরা বুঝতে পারছেন না।
বীর বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত ১৮৮৮ সালের ৩০ আগস্ট চন্দননগর সরিষা পাড়ায় মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি ছিল হুগলির বেগমপুরে। পিতা চুনিলাল দত্ত ছিলেন ইংরেজ সরকারের নৌ বিভাগের হিসাবরক্ষক। ছোটবেলায় মুম্বইয়ের গিরগাঁও এরিয়ান এডুকেশন সোসাইটিতে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরু হয়। পরবর্তীকালে ডুপ্লেক্স বিদ্যামন্দির যা বর্তমানে কানাইলাল বিদ্যামন্দির নামে পরিচিত- সেখানেই তিনি তাঁর স্কুলের পড়াশোনা করেন। স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি মহসিন কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯০৮ সালে বিএ পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দেওয়া ও রাজদ্রোহিতার অপরাধে যেহেতু তিনি কারাগারে বন্দি ছিলেন তাই তাকে ডিগ্রী দিতে বাধা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সমস্ত বাধাকে অগ্রাহ্য করে শেষ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বিএ ডিগ্রি প্রদান করে সম্মানিত করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত হয়ে পড়েন। চন্দননগরের যুগান্তর পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চারুচন্দ্র রায়ের অনুপ্রেরণায় কানাইলাল বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হন।
বিএ পরীক্ষার শেষে তিনি সক্রিয়ভাবে গুপ্ত বিপ্লবী গোষ্ঠীর কাজে অংশগ্রহণ করেন। সেই সময় তিনি ভবানীপুরে একটি বাড়িতে থেকে গোপনে বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপ চালাতেন। ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল বিহারে অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টা করেন প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু। কিংসফোর্ডকে হত্যার চেষ্টার ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ব্রিটিশ সরকার সেই সময় অরবিন্দ ঘোষ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ ও কানাইলাল দত্তকে গ্রেফতার করে তাঁদের প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি করে রাখা হয়। সেই সময় বিশ্বাসঘাতক নরেন্দ্রনাথ গোস্বামী বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে যায়। এর প্রভাব ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অনেক সুদূরপ্রসারী হতে পারে তা চিন্তা করে প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি আর এক বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে সঙ্গে নিয়ে কানাইলাল জেল হাসপাতালের ভিতর বিশ্বাসঘাতক নরেনকে হত্যা করেন। এই ঘটনায় বিচারের ফলস্বরূপ কানাইলালকে ফাঁসির সাজা শোনানো হয়।
বিচারের রায় শোনার পর সেদিন নির্ভীক কানাইলাল এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে বারণ করেছিলেন।
১৯০৮ সালের ১০ নভেম্বর ফাঁসির দিন ঠিক করা হয়। ঐতিহাসিক তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় ফাঁসির ঠিক আগের দিন কানাইলালের দাদা আশুতোষ দত্ত তাঁর সঙ্গে দেখা করে ভাইয়ের কাছে শেষ স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তার চশমাটা চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রচন্ড হাই পাওয়ারের চশমা থাকার দরুন সেদিন দাদাকে কানাইলাল বলেছিলেন ঠিকমতো দেখতে না পাওয়ার জন্য ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে যদি কোনও কারণে হোঁচট খান তবে কথা উঠতে পারে যে বাঙালি মৃত্যুর আগে ভয় পাচ্ছে। তাই সেদিন দাদাকে বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁর চশমাটা নেন। ফাঁসির পর সেই চশমাটা তাঁর পরিবার নিয়ে এসেছিলেন যা বর্তমানে চন্দননগর ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউটে অত্যন্ত সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে।
ইতিহাস বলে, আজ পর্যন্ত ফাঁসির মঞ্চে ওঠার আগে যাকে ফাঁসি দেওয়া হয় তার মুখ কালো কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয়। কিন্তু কানাইলাল এই ভারতের প্রথম ব্যক্তি যিনি অনুরোধ করেছিলেন ফাঁসির আগে তাঁর মুখ যেন কালো কাপড়ে ঢাকা না হয়। সেদিন তাঁর ইচ্ছেকে মান্যতা দিয়ে মুখ না ঢেকেই ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল নির্ভীক এই বীর বাঙালি কানাইলাল দত্তকে। আজকে স্বাধীনতার এই গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসকে আমরা ভুলতে বসেছি।
শনিবার ৩০ আগস্ট তাঁর জন্মদিনে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সহ রাসবিহারী রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়।
কিন্তু পাশাপাশি চন্দননগরের যে বাড়িতে এই বিপ্লবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন তাঁর সেই স্মৃতিচিহ্নটুকু মুছে ফেলার জন্য কিছুদিন আগেই চন্দননগর পৌরনিগমের পক্ষ থেকে বিপজ্জনক বাড়ি চিহ্নিত করে তাকে অপসারণ নোটিশ দিয়েছে যার জেরে গোটা চন্দননগরবাসী গভীরভাবে মর্মাহত ও ব্যথিত।
পাশাপাশি তাঁরা দাবি করেছেন চন্দননগরের বুকে এরকম বহু বিপজ্জনক বাড়ি রয়েছে যার অবস্থা এই বাড়িটির থেকেও খারাপ। সেই বাড়িগুলো আজও রয়েছে। কিন্তু ঐতিহ্যমন্ডিত ইতিহাসের সাক্ষ্য বহনকারী এই বাড়িটিকেই ভেঙে ফেলার অর্থ ইতিহাসকে মুছে ফেলা, ইতিহাসকে অসম্মান করা। তাঁদের দাবি প্রশাসন যদি উদ্যোগ নিয়ে এই বাড়িটিকে সংরক্ষণ করে তবে সমস্ত চন্দননগরের মানুষ সর্বতোভাবে প্রশাসনের কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।