নীলাঞ্জন দাশগুপ্ত
কলকাতার বইমেলায় যতই নতুন লেখকের ভিড় হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত আলোটা কে কেড়ে নেবে সেটা সবাই জানে। সাধারণ লেখকেরা পাঠকের মন জয় করার জন্য কলম ধরেন, আর মুখ্যমন্ত্রী কলম ধরেন পাঠকের সহ্যশক্তি যাচাই করার জন্য। আগের বইগুলো নিয়ে পাঠকের মনে এখনো এত প্রশ্ন জমে আছে যে, মনে হয় যেন অঙ্কের খাতায় উত্তরহীন সমীকরণ। তার মাঝেই আবার নতুন বই হাজির।
ভাবুন তো, যে কবিতার বইতে তিনি নিজেকে দেবী বানিয়েছিলেন, যে আত্মজীবনীতে নিজেকে শহীদ বানিয়েছিলেন, যে ছড়ার বইতে প্রতিপক্ষকে বানিয়েছিলেন খলনায়ক, সেই দিদিই এবার প্রধানমন্ত্রীদের শিক্ষক। যেন ইতিহাসের রেজাল্ট কার্ড তিনি নিজেই লিখে দেবেন। কে দয়ালু, কে হিটলারসুলভ, সব বিচার হবে তাঁর কলমে। দেশের ইতিহাস বুঝি এবার ছন্দোবদ্ধ গদ্যে লেখা হবে। জনগণ যখন কাজ, চাকরি, উন্নতি চাইছে, তখন তাঁদের হাতে ধরানো হচ্ছে কবিতার খাতা, ছড়ার খাতা, আত্মজীবনীর খাতা, আর এখন প্রধানমন্ত্রী বিশ্লেষণের খাতা। বাজারে যখন আলু-পটল নেই, তখন বইয়ের দোকানে দিদির নতুন বই একেবারে গরমাগরম। পাঠক প্রেমের উপন্যাস কিনতে গেলে দোকানদার হয়তো বলে বসবে“আরে প্রেম ভুলে যান, প্রধানমন্ত্রীদের গল্পে মশলা বেশি!”
ওনার কবিতা পড়ে অনেকেই ভেবেছিল এগুলো আসলে কোনো গুপ্ত সংকেত। হয়তো প্রশাসনিক নোটিশের ভাষা, হয়তো স্বপ্নের ডায়েরি। রাজনৈতিক প্রবন্ধ পড়ে কারো মনে হয়েছে সংসদের হট্টগোল শব্দে রূপান্তরিত হয়েছে, আবার কারো মনে হয়েছে, এই লেখা পড়তে পড়তে হাওয়া বদলের প্রয়োজন পড়বে। তবুও নতুন বই আসবেই, কারণ ওনার লেখনী থামে না।
পাঠকেরা বই কিনে বাড়ি ফেরে, শেলফে সাজায়, তারপর সেই বই নীরবে বসে থাকে। মাঝেমধ্যে ধুলো ঝাড়ার সময় বইটা চোখে পড়ে, আর বুক ধড়ফড় করে ওঠে, কোন পাতায় হাত দিলে হজমের সমস্যা শুরু হবে কে জানে। কিন্তু তারপরও মানুষ কেনে। কারণ এই বই পড়া না পড়া নয়, বরং ঘরে রাখা মানেই মর্যাদা। এটা যেন বই নয়, রাজনৈতিক ব্যাজ, কে কোন দলে, সেটা আলমারির ভেতর দিয়েই বোঝা যায়।
প্রকাশকরা খুশি, কারণ বিক্রি তো হয়ই। সমালোচকেরা যত বেশি কটাক্ষ করে, বইয়ের দামি কভার তত বেশি ঝলমল করে। আর পাঠকেরা ভাবে, না পড়লেও অন্তত দেখিয়ে বলা যাবে, ইতিহাসের সাক্ষী আছি।
মজার ব্যাপার হলো, ওনার বই পড়া মানে এক ধরনের যোগব্যায়াম। কেউ নিদ্রা যোগ পান, কেউ ধৈর্য যোগ। এমনও শোনা যায়, পরীক্ষার আগে ঘুম না এলে ছাত্রছাত্রীরা এই বই খুলে বসে। কয়েক মিনিটেই ঘুম এসে যায়, আর পরীক্ষার হলেই চোখ খোলে।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর বই আসলে কৌশলও বটে। রাজনীতিতে যেমন প্রতিপক্ষকে চমকে দেওয়া হয়, বইতেও ঠিক তেমন চমক। পাঠক পড়তে না পড়তে বইমেলায় নতুন বই এসে হাজির হয়। মনে হয়, সাহিত্য এখানে স্রেফ মঞ্চ, আর বইগুলো একেকটা রাজনৈতিক ব্যানার।
শেষ পর্যন্ত পাঠকের অবস্থা দাঁড়ায় এমন, বই কিনে ছবি তুলতে হবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিতে হবে, তারপর বইটা সযত্নে আলমারিতে তুলে রাখতে হবে। পড়া যাবে কিনা সেটা বড় প্রশ্ন নয়, কারণ মুখ্যমন্ত্রীর বই পড়ার সাহস তো সবাই পায় না।