সন্দীপন বিশ্বাস
ঈশিতা খুনের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত দেশরাজ অবশেষে পুলিশের জালে। সাতদিনের মাথায় সে গ্রেপ্তার হওয়ার খবর প্রতিটি সংবাদপত্র গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। সাধারণ মানুষও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। কিন্তু একটা কথা ভাবার আছে। সত্যিই কি স্বস্তি ফিরে আসবে মেয়েদের মনে? এ সমাজে কি তারা এখনও নিজেদের নিরাপদ মনে করে? প্রতিদিন সংবাদপত্রে নারী হত্যা, লাঞ্ছনা, অত্যাচার, ধর্ষণের খবর পড়তে হয়। তবু সমাজ জাগে না। এই সমাজ আজও মেয়েদের অবাঞ্ছিত বলেই মনে করে। এই বিষ ভাবনা আমাদের মধ্যে একটা সংস্কারের মতো, অন্ধবিশ্বাসের মতো জেগে অআছে।
অন্ধ্রপ্রদেশের পশ্চিম গোদাবরী জেলার এলুরুতে কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন মহালক্ষ্মী। কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর থেকেই তাঁর উপর শুরু হয় পরিবারের সদস্যদের অত্যাচার। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কন্যার জন্মের ১৪ দিনের মাথায় মা তাঁর সন্তানের মুখে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। তিরুপতি জেলায় এক বাবা তার দুই কন্যা সন্তানকে গলা টিপে হত্যা করেছে। রাজস্থানের বেশ কয়েকটি জেলায় পর পর বেশ কয়েকটি কন্যাসন্তানকে জন্মের পরই মেরে ফেলার প্রমাণ মিলেছে। এগুলি একেবারে সাম্প্রতিক ঘটনা। এই সমাজে মেয়েদের এখনও অবাঞ্ছিত বলে মনে করা হয়। কন্যা মানেই এক দায়, তাই তাকে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলা হয়। সেই পুরাণকাল থেকে এই আদিম ধারণা আজকের আধুনিকতায় মোড়া ঝকঝকে জীবনেও জড়িয়ে রয়েছে। এখনও তার পুরোপুরি পরিবর্তন হয়নি।
এই সমাজে রাস্তায় কুকুরকে বিষপ্রয়োগে মেরে ফেললে তার প্রতিবাদে সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন হয়। সেটা অবশ্যই হওয়া দরকার। পাশাপাশি যেভাবে আমাদের দেশে জন্মানোর পরই শিশুকন্যাদের মেরে ফেলা হয়, তার জন্য কোনও শাস্তি হয় না, ফলপ্রসূ আন্দোলনও গড়ে ওঠেনি। পদ্ধতিগুলো কতটা নৃশংস হতে পারে, আমরা তা ভাবতেই পারি না। রাজস্থানের গ্রামে জন্ম নেওয়া অবাঞ্ছিত শিশুকন্যারা জন্মের পর যেই কেঁদে ওঠে, অমনি তাদের মুখের মধ্যে বালি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নাকে গুঁজে দেওয়া হয় তামাক। অনেক জায়গায় শিশুকন্যাকে দমবন্ধ করে মেরে তার মুখে গুড় দিয়ে বলা হয়, পরের জন্মে ছেলে হয়ে জন্মাস। অনেক রাজ্যে সদ্যপ্রসূত শিশুকন্যাকে মাটির হাঁড়িতে ভরে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়।
কয়েক বছর আগে প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, উত্তর ভারতের ১৩২টি গ্রামে তিন মাসের মধ্যে কোনও কন্যাসন্তান জন্মায়নি। সেই সময়ের মধ্যে গ্রামগুলিতে পুত্রসন্তান জন্মেছিল ২০০। এর মধ্যে উত্তরাখণ্ডের গ্রামই বেশি।
২০১৫ সালে মোদি সরকারের তৎকালীন নারী ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী মানেকা গান্ধী বলেছিলেন, আমাদের দেশে প্রতিদিন দু’হাজার মেয়েকে খুন করা হয়। এরমধ্যে বহু সদ্যোজাত কন্যাকে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারা হয়। অর্থাৎ এখনও সরকারের ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ কেবল স্লোগানই রয়ে গেল। আর সেই স্লোগান সর্বস্বতার অন্ধকারে আমাদের দেশে প্রতিদিন কত নারী নির্যাতিত হয়ে চলেছে, প্রতিদিন কত নারী তিল তিল যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে আছে, কেউ তার হিসাব রাখে না।
জয়সলমিরের এক গ্রামে ছেলেদের জন্ম থেকে শেখানো হয়, গ্রামের একটি কুয়োর জল খেলে তারা শুধু পুত্র সন্তানেরই বাবা হবে। ছোট থেকেই পুরুষদের মনে মেয়েদের সম্পর্কে এই ঘৃণা তৈরির সংস্কৃতিটা সেই প্রাচীনকাল অতিক্রম করে মধ্যযুগ পেরিয়ে বর্তমান কালেও বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ভারতীয় সংবিধানের ধারা আউড়ে যখন নেতা, মন্ত্রীরা মঞ্চে মঞ্চে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলে হাততালি কুড়োন, তখন তাকে মিথ্যাচার বলেই মনে হয়।
২০১১ সালে শেষ জনগণনা অনুযায়ী আমাদের দেশে লিঙ্গ ভারসাম্যের হার ছিল প্রতি এক হাজার পুরুষের মধ্যে ৯৪৩ জন মহিলা। তারপর আরও ১২ বছর কেটে গিয়েছে। এই ফারাক আরও বাড়তে পারে। হ্যাঁ বাড়তে পারে, কেননা এখনও দেশের বহু নার্সিং হোম গোপনে গর্ভবতী নারীর লিঙ্গ নির্ধারণ করছে এবং স্ত্রী লিঙ্গ হলে গর্ভপাত করে অবৈধ উপায়ে রোজগার করছে। আমাদের দেশে লিঙ্গ নির্ধারণ বেআইনি। একবার মানেকা গান্ধী প্রস্তাব দিয়ে বলেছিলেন, লিঙ্গ নির্ধারণ বৈধ করা হোক এবং সরকারের রেজিস্টারে তা লিপিবদ্ধ করা থাকুক। জন্মের সময় তা মিলিয়ে দেখা হবে। এতে কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হবে। আমাদের খুনে মানসিকতার জন্য আজও বহু কন্যা দেখেনি পৃথিবীর আলো।
আসলে যুগ যুগ ধরে আমাদের মানসিকতায় পুত্রের স্থান রয়ে গিয়েছে। আমাদের সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। এখানে পুত্রসন্তানকে ধনসম্পদ হিসাবে মনে করা হয়। পাশাপাশি কন্যাসন্তানকে দায় হিসাবে মনে করা হয়। দরিদ্র সমাজ ব্যবস্থায় কন্যা জন্মানোর পরই মনে করা হয়, মেয়ে বড় হলে অনেক বেশি পণ দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ মেয়েকে বড় করার জন্য যা বিনিয়োগ সবই জলে। উল্টোদিকে ছেলেরা রোজগার করে বাবা-মায়ের লালন পালন করবে, বিয়ে করে পণ নিয়ে আসবে। সম্পত্তির অধিকার রক্ষা করবে আর বংশে ‘বাতি’ দেবে। তাই একই সংসারে পুত্র যতটা যত্নে বড় হয়, কন্যা সন্তান ততটাই অযত্নে বড় হয়।
আমাদের শাস্ত্রে রয়েছে, পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। এটাকেই পারিবারিক জীবনের ধর্ম বলে মানা হতো। অর্থাৎ বিবাহের মূল উদ্দেশ্যই ছিল পুত্র উৎপাদন। সেই পুরাণ আর শাস্ত্র আবার নারীকে মনে করত ‘নরকের দ্বার’। অর্থাৎ আমাদের শাস্ত্রই নারীকে খুব নিম্ন মানসিকতার সঙ্গে দেখার শিক্ষা দিয়ে গিয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ কখনও নারীর অধিকার স্বীকার করতে চায়নি। অথচ কী আশ্চর্য ও বৈপরীত্য! মাটি বা পাথরের দেবীমূর্তিকে আমার পোশাক পরিয়ে পুজো করছি। আর বাস্তব জগতে দুষ্কৃতীরা মহিলাদের পোশাক খুলে নিয়ে তাদের অপমানের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পুরুষশাসিত সমাজে মাতৃতান্ত্রিক আরাধনার এ এক মিথ্যাচার! যে মানসিকতা নিয়ে আমরা দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, শীতলা সহ তেত্রিশ কোটি দেবতার পুজো করি, সেখানে আমরাই মেয়েদের নানাভাবে নিপীড়ন করি। আজ আমাদের দেশে অনেক দুর্যোধন, অনেক দুঃশাসন, অনেক ধৃতরাষ্ট্র ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদের প্রতিহত করার জন্য দরকার নতুন করে জেগে ওঠার।
সাম্প্রতিক উদাহরণ, মণিপুর। সেখানে রাষ্ট্রের হাতে নারীত্বের যে লাঞ্ছনা, তা যেন আমাদের সভ্যতার মুখে কালি লেপে দিয়েছে। আমার যেন আবার সেই পুরাণের রাজতন্ত্রের যুগে ফিরে যাচ্ছি। যেখানে লাঞ্ছিত হয়েছিলেন সীতা। শ্লীলতাহানি করা হয়েছিল দ্রৌপদীর। আর কৌরবদের সভায় উপস্থিত সকলে তারিয়ে তারিয়ে তা উপভোগ করেছিলেন। আজও যেন কৌরবের দেশে আমরা বাস করছি। সারা দেশের মানুষ প্রজ্বলন্ত প্রতিবাদ না করে ভাইরাল হওয়া ভিডিও উপভোগ করছে।
হায়রে, এটাই বোধহয় আমাদের দেশের ভবিতব্য! আজও আমাদের সমাজের মেয়েরা প্রতি মুহূর্তে লাঞ্ছিত হয়ে চলেছে। গত পাঁচ বছরে আমাদের দেশে ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে গিয়েছে প্রায় সাতাশ শতাংশ। শুধু কী ধর্ষণ কিংবা শ্লীলতাহানি? তার পরেও রয়েছে নিপীড়নের অজস্র ক্ষতচিহ্ন! ভ্রূণহত্যা থেকে শুরু করে নাবালিকাকে যৌন হেনস্তা, অ্যাসিড আক্রমণ, কর্মস্থলে হেনস্তা, অপহরণ, নারী পাচার এসব তো আছেই। কর্মক্ষেত্রেও লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার মেয়েরা। কোনও একটি শ্রমের মূল্য পুরুষরা যতটা পায়। সম শ্রমের মূল্য মেয়েরা ততটা পায় না। যেমন অভিনয় জগৎ বা খেলাধুলোর জগৎ। সারা বিশ্বেই এই বৈষম্য চলছে। দেখা গিয়েছে, মেয়েদের ব্যাপারে কমবেশি সব দেশের মধ্যেই একটা চোরা তালিবান মানসিকতা কাজ করছে।
আবার দেখা গিয়েছে, মেয়েরা বাইরের জগতের থেকে বেশি হিংসার শিকার তার ঘরের মধ্যে। অর্থাৎ নিরাপদ আশ্রয়ের মধ্যেই মেয়েদের সব থেকে বেশি নিরাপত্তাহীনতা। প্রতি চার মিনিটে একজন মহিলা তার শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার। কেন তার বাবা পণ দিতে পারেনি, কেন সে পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারছে না ইত্যাদি কারণে মেয়েরা আজ সব থেকে বেশি অত্যাচারিত। সম্পর্কের খাতিরে বা দু’মুঠো ভাতের জন্য বহু মেয়ে আজও মুখ বুজে সেই অত্যাচার সহ্য করে অথবা তাদের পুড়িয়ে মারা হয়। অনেকেই আবার আত্মহননের মধ্য দিয়ে হিমশীতল জীবনে পৌঁছে যায়। কিন্তু পুরুষদের শেখানো হয় না যে, গর্ভস্থ সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করার ক্ষমতা প্রকৃতি নারীকে দেয়নি। লিঙ্গ নির্ধারণ করে পুরুষের ক্রোমোজম। তবুও মেয়েরা নির্যাতনের শিকার!
হায়রে মেয়ে! রবীন্দ্রনাথ তাই বুঝি বলেছিলেন, ‘হায়রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়’! ওদের অধিকাংশের জীবন যেন ‘বিকিয়ে যায় মরীচিকার দামে’!
তাহলে ভবিষ্যৎ কী? বিলকিস বানো ধর্ষণ মামলা সহ বিভিন্ন মামলায় জেল খাটা আসামিরা যখন সরকারের বদান্যতায় ছাড়া পেয়ে সমাজে কলার তুলে ঘুরে বেড়ায়, তখন দুষ্কৃতীরা নারীর সম্ভ্রম কেড়ে নেওয়ার প্রশ্রয় পায়। যেন রাষ্ট্রের ঔরসে জন্ম নিচ্ছে এই সব দুষ্কৃতী।
দীর্ঘদিনের এই নারীত্বের অবমাননা রাতারাতি শেষ হয়ে যাবে না। বদল আনা দরকার আমাদের মন ও মানসিকতায়। বদল আনা দরকার আমাদের সংস্কৃতিতে। হাবিজাবি সিনেমা আর অসুস্থ ভাবনা সমন্বিত সিরিয়ালের গল্প আমাদের সমাজে গভীর প্রভাব ফেলছে। আমরা জানি না কবে শেষ হবে মেয়েদের অবমাননা। ‘নারী, তুমি অর্ধেক আকাশ’ এই কথাটি স্তোকবাক্য না হয়ে জীবনে সত্য হয়ে উঠুক। জানি না, এই অন্ধকার পথের শেষ কোথায়?