আদালত মানেই নাকি ন্যায়ের আসন। কিন্তু এ রাজ্যে আদালতের ক্যালেন্ডারটাই যেন সরকারের নতুন রক্ষাকবচ! এভাবেই শুরু হতে পারে যেকোনো সরকারি কর্মচারীর দিনলিপি। একদিন তারিখ পড়ে, আরেকদিন আশা জাগে, তারপর হঠাৎই আবার নতুন তারিখে ঠেলাঠেলি। যেন কোনও পুরনো সিনেমার রিপিট টেলিকাস্ট, কাহিনি জানা, শেষটাও জানা, শুধু দর্শকদের ধৈর্য নিংড়ে নেওয়াটাই আসল খেলা। সরকারি কর্মচারীদের বেতনবৃদ্ধির পাওনা আজ আদালতের ফাইলের ভাঁজে চাপা পড়ে রয়েছে। তাঁদের মুখ শুকিয়ে কাঠ, সংসারের খরচ পাহাড়, অথচ আদালতের ঘড়িতে বাজছে শুধু পরবর্তী শুনানি-র ঘণ্টা।
কিন্তু রাজ্যের রাস্তায় একটু হাঁটলেই দেখা যাবে অন্য ছবি। মিষ্টির গন্ধ, আলো ঝলমল, মণ্ডপের সামনে বিশাল হোর্ডিং, উৎসব আমাদের গর্ব। কে না জানে, বাঙালির প্রাণের উৎসব দুর্গাপূজা। কিন্তু এ ক’দিনে দেবী দর্শনের ভিড়ের চেয়ে রাজনৈতিক দর্শনের ভিড়টাই চোখে লাগে বেশি। পাড়ার ক্লাব মানেই ভোটের তীর, আর তাই সরকারের সিন্দুক খুলে যাচ্ছে হাজারে হাজারে। এক লক্ষ দশ হাজার টাকা করে প্রতিটি ক্লাব, আহা, বাহবা! কর্মচারীরা ভাত জোগাড় করতে পারেন না, কিন্তু প্যান্ডেলের ছাদে ঝুলবে এসি, সাজসজ্জায় ঝলমল করবে সরকারি নোটের গন্ধ। এ যেন এক অদ্ভুত কাণ্ড,একদিকে আদালতের করিডরে ঝুলে থাকা সরকারি কর্মচারীর দীর্ঘশ্বাস, অন্যদিকে প্যান্ডেলে ফোটানো ফুচকার মতো ফুটফুটে হাসি। দেবীর ভোগের পাতে এবার গরম গরম রাজনীতি পরিবেশন হবে, তার সঙ্গে থাকবে অনুদানের মশলা। জনগণ বুঝে ফেলছে, এ কেবল দুর্গাপূজার অনুদান নয়, এ এক বিশেষ ধরণের রাজনৈতিক প্রসাদ। দেবীর ছদ্মবেশে ভোটের থালা।
সরকারি কর্মচারীরা বলছেন, আমাদের ন্যায্য পাওনা কি তবে চিরকালই আদালতের ধুলোমাখা বেঞ্চে পড়ে থাকবে? কিন্তু ঢাকের আওয়াজ এত জোরে বাজে যে তাঁদের চিৎকার চাপা পড়ে যায়। স্কুলে ফি, হাসপাতালে ওষুধ, বাজারে দুধ আর গ্যাস, সব কিছুর দাম আকাশছোঁয়া, অথচ তাঁদের বেতনবৃদ্ধি ক্যালেন্ডারের পাতায় আটকে থাকে। অপরদিকে, দুর্গাপূজার ছটফটে বাজেট নিয়ে শোভাযাত্রা বেরোয়।
এই দৃশ্যটা কল্পনা করুন, আদালতের সিঁড়িতে সার বেঁধে দাঁড়িয়ে সরকারি কর্মচারীরা, চোখে অনিশ্চয়তা। আর একই সময়ে পাড়ার ক্লাবে আলো ঝলমলে প্যান্ডেল, যেখানে সোনালী অক্ষরে লেখা, সরকার আমাদের পাশে। পাশে কার? কর্মচারীর না ভোটব্যাঙ্কের? প্রশ্নটা বাতাসে ঝুলছে।
এ রাজ্যে উৎসব যেন অধিকারকে গ্রাস করছে। দেবীর আগমনী গান ঢেকে দিচ্ছে কর্মচারীর দীর্ঘশ্বাস। অনুদানের বন্যায় ভিজছে ক্লাবের মাঠ, কিন্তু কর্মচারীর সংসারে শুকিয়ে যাচ্ছে হাসি।
দেবী আসবেন, দেবী যাবেন। মণ্ডপে আলো জ্বলবে, ঢাক বাজবে, ক্লাবে ফোটানো কচুরি-ছানার গন্ধ ছড়াবে। কিন্তু সরকারি কর্মচারীর বেতন দাবির ফাইল হয়তো পরবর্তী তারিখেই আটকে থাকবে। জনগণ এখন ভাবছে এই “উৎসব রাজনীতি”র অন্তরালে আসল দেবী কে? দুর্গা, না ভোটদেবী? আর আগামী নির্বাচনে সত্যিই কি দেবীর মণ্ডপে জনতার ক্ষোভের ঢাক বাজবে?