শুভম দে
নাহ্ তিনি বাঙালি নন। তাঁর জন্ম উত্তরপ্রদেশের আমরোহা গ্রামে। বেড়ে ওঠাও সেখানে। তবুও তাঁর সাফল্যে বাঙালি হৃদয় উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। কারণ বাঙালির কাছে অনেক কিছুর জবাব তিনি। দীর্ঘদিনের বঞ্চনার জবাব। দীর্ঘদিনের অন্যায়ের জবাব।
কথা হচ্ছে মহম্মদ শামিকে নিয়ে। উত্তরপ্রদেশের তৌসিফ আলির স্বপ্ন থাকলেও স্বপ্নপূরণ হয়ে ওঠেনি। তাই চার সন্তানের প্রত্যেককেই চেয়েছিলেন ফাস্ট বোলার বানাতে। যার মধ্যে একমাত্র শামি বরাবরই গতিতে টেক্কা দিতেন বাকিদের। তাই ছেলেকে নিয়ে গেলেন কোচ বদরুদ্দিনের কাছে। বছর পনেরোর ছেলেটার প্রতিভা দেখে তো কোচ অবাক। বুঝেছিলেন এ ছেলে অনেক দূর যাবে। আর ছেলেটিও কঠোর পরিশ্রমী। একটা দিনের জন্যেও অনুশীলন বন্ধ করে না। কঠোর অনুশীলন, অনুশীলন আর অনুশীলন এই ছিল কিশোর শামির রোজকার রুটিন। যা আজও বদলায়নি।
উত্তরপ্রদেশে শামির পক্ষে জায়গা করে নেওয়া মুশকিল তাই শামিকে কলকাতা যাওয়ার পরামর্শ দিলেন কোচ বদরুদ্দিন। সেই শুরু। বছর সতেরোর শামি আহমেদ থেকে কার্যত হয়ে উঠলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের বোলিং অধিনায়ক মহম্মদ শামি। আর সিটি অফ জয় আপন করে নিল উত্তরপ্রদেশের কিশোরটিকে।
রাস্তাটা কিন্তু সহজ ছিল না একেবারেই। সম্পূর্ণ নতুন একটা জায়গায় এসে অথৈ জলে পড়েছিলেন শামি। খেলা শুরু করেন ডালহৌসি অ্যাথলেটিক ক্লাবের হয়ে। নজরে পড়ে যান দেবব্রত দাসের। সেখান থেকে টাউন ক্লাব, মোহনবাগান হয়ে বাংলা রনজি দল এবং অবশেষে জাতীয় দল। সুদীর্ঘ যাত্রাপথে এসেছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। কিন্তু মহম্মদ শামি বোলড আউট করে গেছেন একের পর এক বাধা-বিপত্তি। পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখা যাবে শামির নেওয়া বেশিরভাগ উইকেটই ক্লিন বোল্ড! আসলে বরাবরই স্টাম্প ছিটকে দিতে তাঁর ভাল লাগে। তিনি চান বারবার স্টাম্পে হিট করতে। বারবার উইকেট ছিটকে দিতে। একবার একটা ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, বল যখন স্টাম্পে হিট করে, ক্লিন বোল্ডের সেই যে মধুর আওয়াজ তাঁর ভারী পছন্দের। ফাস্ট বোলিং যে তাঁর কাছে একটা সাধনা। নইলে ক’জন এরকম বলতে পারেন?
এদেশে ছোটবেলায় সবাই ভাবে শচীন বা সৌরভ হবে। কিন্তু ঠিক কজন ভাবে জাহির খান হব? কিন্তু শামি ভেবেছিলেন। জাহির খানকে অনুপ্রেরণা করে ওই নীল জার্সিটা পরে দেশের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। দেশকে ম্যাচ জেতানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন বল হাতে!
দেশের হয়ে টেস্ট অভিষেকে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং ফিগার (৯/১১৮ বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কলকাতা, ২০১৩) থেকে শুরু করে হাঁটুর চোট নিয়ে ২০১৫ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ১৭.২৯ গড়ে ১৭ উইকেট নিয়ে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে সর্বাধিক উইকেট হোক বা ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বকাপে দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে হ্যাটট্রিক হোক বা ঘরের মাঠে ২০২৩ বিশ্বকাপে সর্বাধিক উইকেট হোক কিংবা আইসিসি টুর্নামেন্টে ভারতীয়দের মধ্যে সর্বাধিক উইকেট, জাতীয় দলের হয়ে তাঁর কীর্তি অনেক। কিন্তু বাঙালির কাছে তিনি ঠিক কী?
তিনি বাঙালি নন ঠিকই, শামিকে ঘিরে আপামর বাঙালি আবেগ ভাসতে নাই পারেন, কিন্তু দিনের শেষে মহম্মদ শামি কিন্তু বাংলার প্লেয়ার। জাতীয় দলে বাংলা থেকেই সুযোগ এসেছে। তাই একেবারেই কি শামি এই বাংলার কাছে কিছু না? এ নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। তবে মহম্মদ শামি জাতীয় দলে বাংলার বঞ্চনার বিরুদ্ধে যে বাঙালির জবাব, তা নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না।
জাতীয় দলে বাংলার ক্রিকেটাররা বরাবর ব্রাত্য থেকেছেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে। সৌরভ গাঙ্গুলি নেহাত ব্যতিক্রম। বাংলা থেকে যখনই কেউ সুযোগ পেয়েছেন, ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাকে খেলানো হয়েছে। কারণ কী? না, তোমার কাছে সুযোগ মাত্র একটা সিরিজ কি মাত্র একটা কি দুটো ম্যাচ। তোমায় নিজেকে প্রমাণ করতে হবে ওই টুকু সময়ের মধ্যে। নাহলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে তোমায়। এরপর যতই তুমি তোমার ঘরোয়া ক্রিকেটের পারফরম্যান্স নিয়ে জাতীয় দলের দরজায় কড়া নাড়ো না কেন, দরজাটা খুলবে না। আর এসব কিছুই হবে তুমি বাংলা থেকে এসেছো বলে! এমনকি জাতীয় দলে ঢোকার আগে যে প্রিলিমিনারি (পড়ুন আইপিএল) এক্সামটা দিতে হয়, সেখানেও ব্রাত্য করে রাখা হবে তোমায়। কারণ তুমি বাংলার হয়ে খেলো বলে। তাই বাঙালির কাছে জাতীয় দল মানে খানিকটা…
‘তারে ধরি ধরি মনে করি
ধরতে গেলেম, আর পেলেম না!’
তুমি সুযোগ পেলে, কিন্তু জাতীয় দলে ঠিকঠাকভাবে নিজের জায়গা পাকা করার আগেই জাতীয় দল থেকে তুমি বাদ পড়বে অজ্ঞাত কারণে। কেন? তার কোনও উত্তর নেই। তাই জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া বাঙালির কাছে চিরকাল মরীচিকার মতো। বাংলা থেকে কেউ সুযোগ পেয়েছে এই আনন্দ অনুভূতি থিতু হওযার আগেই দুঃসংবাদের মতো আঘাত করে তার বাদ পড়া!
আর মহম্মদ শামি এসব কিছুর বিরুদ্ধেই বাংলার প্রত্যুত্তর সমগ্র দেশের কাছে। জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়াই শুধু নয়, যত দিন গেছে জাতীয় দলের কাছে শামি হয়ে উঠেছেন এক অমূল্য সম্পদ। যে সম্পদের খোঁজে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে ভারতীয় ক্রিকেটকে— একজন আদর্শ ফাস্ট বোলার। কয়েক বছর আগে ভুবি-বুমরাহ-ইশান্ত-উমেশ সংবলিত যে ভারতীয় পেস বিভাগ ক্রিকেট বিশ্বের যে কোনও দলের কাছে ত্রাস হয়ে উঠেছিল, সেই দলটাকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গ ক্রিকেট থেকে উঠে আসা একজন ক্রিকেটার, যার নাম মহম্মদ শামি। বাঙালির কাছে এ তো কম পাওয়া নয়!
দিনের পর দিন নিজের অসাধারণত্ব দিয়ে ভরসা অর্জন করেছেন ক্যাপ্টেন কোহলি থেকে রোহিতের। শামি ছাড়া ভারতীয় দল ভাবতে পারেননি নির্বাচকরা। তিনি অটোমেটিক চয়েস। ব্রেক থ্রু দরকার? ক্যাপ্টেন বল বাড়িয়ে দিয়েছেন শামির দিকে। উইকেট তুলে নিয়ে শামি তাঁর যোগ্যতাও প্রমাণ করছেন বারবার। হয়ে উঠেছেন জাতীয় দলের এক অপরিহার্য অংশ। শেষ কবে এমনটা হয়েছে? বাংলার কোনও ক্রিকেটার ছাড়া নাকি ভারতীয় দল অসম্পূর্ণ? প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সারা দেশ তাকিয়ে আছে বাংলার কারও দিকে? আর কীই বা চাইতে পারি আমরা?
সঠিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ উইকেট তুলে নেওয়ার পর ক্যাপ্টেন কোহলি বা রোহিত যখন প্রচণ্ড উচ্ছ্বাসে শামির পিঠে হাত রাখতেন বা চুলগুলো ঘেঁটে দিতেন, কোথাও কি বাংলার জয়গান বেজে উঠত না? তাই জন্মসূত্রে উত্তরপ্রদেশের হলেও, শামি সবথেকে বেশি এই বাংলার। একটা গোটা জাতির প্রতীক তিনি। জাতীয় দলে বাংলার প্রতীক তিনি।
আর বাংলা দলের কাছে? শামিভাই মানে সব মুশকিল আসান। জাতীয় দলের ক্রীড়াসূচির কারণে সেভাবে বাংলার হয়ে খেলা হয়ে উঠত না ঠিকই। তবু প্রতিনিয়ত খবর রাখেন প্রিয় বাংলার। আর উইকেটের পেছন থেকে শ্রীবৎস বা বিবেক বা অভিষেক, বা ঈশান-আকাশদীপরা যখন বলে, ‘চলো শামিভাই। উইকেট হবে। উইকেট’, তখন একবারও কি মনে হয় ছেলেটা এই বাংলার নয়?
চোটের কারণে এখন জাতীয় দল থেকে অনেক দূরে। ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে প্রত্যাবর্তনের স্বপ্ন। তবু তাঁর কামব্যাকের দিকে তাকিয়ে গোটা দেশ। শেষ কবে এমনটা হয়েছে? বলিষ্ঠ বোলিং অ্যাকশন, সঙ্গে বিষাক্ত রিভার্স স্যুইংয়ের মালিকের জন্ম হতে পারে উত্তরপ্রদেশে, কিন্তু Shami belongs to BENGAL!