আফগানিস্তানের ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছে শুধুই নিঃশব্দ ব্যথা। মাটির গভীর থেকে উঠে আসা না-বলা আকুতি, আশার সন্ধান খুঁজে বেড়ানো এক অনন্ত অপেক্ষা। গত ৩১ আগস্টের বিধ্বংসী ভূমিকম্পে যখন শত শত গ্রাম হয়ে ওঠে ধ্বংসস্তূপ, তখন গোটা বিশ্বের নজর ছিল উদ্ধারকাজে, মানবতার সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল নিষ্ঠুরতা। তালিবান সরকারের “অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে ত্বকের সংস্পর্শ নিষিদ্ধ” নীতির নামে গড়ে উঠেছে এক অবর্ণনীয় মানবিক সঙ্কট। বিপর্যয়ের সময়, যখন জীবনের তীব্র প্রয়োজনীয়তায় উদ্ধার অভিযান শুরু হওয়ার কথা ছিল, পুরুষ উদ্ধারকর্মীরা দাঁড়িয়ে রইলেন, নিশ্চুপ, নীরব, শুধু তাকিয়ে তাকলেন ফ্যাল ফ্যাল করে। এক অদৃশ্য দেওয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে সেই নীতিমালা বাধা হয়ে দাঁড়াল অজস্র নারী ও মেয়ের বাঁচার আকাঙ্ক্ষার মাঝে।
আয়শা, কুনার প্রদেশের আন্দারলুকাক গ্রামের এক মর্মান্তিক বেঁচে যাওয়া কিশোরী, তার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হল সেই অসহায়তা। “আমাদের দিকে কেউ এগিয়ে আসেনি। আমরা যেন সেখানে ছিলামই না। শুধু কোণে কোণে একত্রিত করে রেখে, যেন আমাদের অস্তিত্ব খর্ব করা হয়।” আয়শার চোখে সঞ্চিত সেই যন্ত্রণা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, যেন মাটি নিজেই কাঁদছে। তীব্র রক্তাক্ত আঘাত নিয়ে সাদা কাপড় জড়িয়ে থাকলেই যেন তা প্রাণের পরিচায়ক। বহু পুরুষ উদ্ধারকর্মী মৃত্যুর গায়ে জড়িয়ে থাকা নারীদের শুধু পোশাক ধরে টেনে বাইরে আনতেন, যেন শরীরের কোনও সংস্পর্শ তাদের নীতিমালার প্রতিবন্ধকতায় ফাটল ধরাতে না পারে। ফলে অনেক নারী মারা গেলেন নীরবে, তাদের শেষ আকুতি মাটির নীচে চিরতরে গুম হয়ে গেল। পাশে দাঁড়ানো মানুষের সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা রয়ে গেলেন নিঃস্ব।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রাষ্ট্রসঙ্ঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই নির্মমতার বিরুদ্ধে তীব্র আওয়াজ তুলেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষ প্রতিনিধি সুশান ফার্গুসন বলেন, “মানবতা কখনও লিঙ্গবৈষম্যের খাঁচায় আটকে থাকা উচিত নয়। মানবতার মুখোমুখি যখন বিপদ, তখন সহানুভূতি ও ত্রাণের পথ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা দরকার।” আফগান নারীদের জীবন আজ যেন এক নির্মম নাটকের পটভূমি, যেখানে কেবল কঠোর বিধি-নিষেধই নয়, বরং মানবিক অন্ধকারও তাদের পথ চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে বিশ্ববাসীর করণীয় একটাই, এই নিষিদ্ধ স্পর্শের অমানবিকতায় যেন আর কোনও নারী মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ না করে। কারণ, নারী শুধুমাত্র মাতৃত্ব বা স্ত্রীর পরিচয়ে নয়, তার নিজস্ব অস্তিত্বের অধিকার নিয়ে এই পৃথিবীতে জন্ম নেয়। তালিবানের নির্মম নীতির গর্ত থেকে উঠে আসতে হবে তাদের, যেন একদিন পৃথিবীর আলো আবার তাদের হাসিতে প্রতিফলিত হয়।
