দোয়েল দত্ত
পুজোর সময় সবকিছুই অন্যরকম। সে খাওয়া হোক বা ঘোরা। আর এত অনিয়ম সহ্য করে শরীর যদি বিদ্রোহ করে তাহলে সমস্যা। পুজোয় জমিয়ে খেয়েও কীভাবে সুস্থ থাকবেন এটা আগাম জেনে রাখুন।
ঢাকের বাদ্যি বেজেছে… পুজোর গন্ধ এসেছে। হ্যাঁ প্রতিবারের মতো এবারও আমরা শারদ উৎসবের দোরগোড়ায় আর পূজো মানেই প্রতিদিনের হিসেবি জীবন থেকে কিছুটা বেশি বেহিসেবী হয়ে দিন কয়েকের জন্য কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা আর তাই পূজা মানেই বাঙালির কাছে ঘোরা, বেড়ানো, প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঘুরে রাত জেগে ঠাকুর দেখার সঙ্গে দেদার খাওয়া দাওয়া। আর পুজোর খাওয়া একটু স্পেশাল না হলে হয় নাকি। সারা বছর যত ডায়েট আর ফিটনেস রুটিন মেনে চলা হোক না কেন পুজোর কদিন এসব কে এক্কেবারে টাটা বাই বাই তার বদলে কব্জি ডুবিয়ে যত চাও তত খাও ।
হিসেব-নিকেশ
পুজো মানে বাঙালির কাছে খাওয়া-দাওয়াটা একটু অন্যরকম এই যেমন ধরুন ষষ্ঠীর লুচি, আলুরদম,কুমড়োর ছক্কা, ধোকার ডালনা কিংবা সপ্তমীর পোলাও, আলুর দম, অষ্টমীতে আবার লুচি, বেগুন ভাজা, ছোলার ডাল কিংবা খিচুড়ি আর লাবড়ার স্বাদ, মুখে লেগে থাকা ভোগ। আর নবমীতে পোলাও আর কচি পাঁঠার ঝোল– উফ এই না হলে বাঙালির পুজো, দশমীতে যখন প্রতিমা ভাসান চলে যাচ্ছে তখনও কিন্তু বাঙালির মধ্যে আছে মিষ্টিমুখ একটু রাবড়ি, বাড়িতে বানানো নারকেল নাড়ু সঙ্গে দরবেশ, রসগোল্লা আর এখনকার দিনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফিউশন সন্দেশ। কী থাকে না বলুন তো বাঙালির খাদ্য তালিকায় সত্যিই তো বছরের পূজো একবারই আসে সুতরাং যত চাও তত খাও এসো বসো আহারে এই সময় যেন বাঙালি জীবনের আপ্তবাক্য হয়ে ওঠে।
অতিরিক্ত খাওয়া ডেকে আনবে না তো কোনও সমস্যা ?
আসলে পুজোর সময় খাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে যায় বলেই এবং সঙ্গে অনিয়ম হয় বলেই এই সময় শরীরে কিন্তু নানা সমস্যা হতে পারে। তবে পুজোয় খেলেই যে শরীর খারাপ হবে এমনটা কিন্তু নয় বাপু। বরং সমস্যাটা অনেক সময় দেখা যায় পুজোর পরে। বিশেষত যেসকল সমস্যাগুলো বেশি দেখা যায় তার মধ্যে আছে বদহজম, অ্যাসিডিটি, চোরা ঢেকুর সঙ্গে জিইআরডি- এর মতো সমস্যা, জিইআরডি হল গ্যাসট্রো ইসোফেশিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ মানে খাওয়ার পর সেই খাবারটা সঠিকভাবে হজম হয় না ফলে সেটা পেটের উপর দিকে উঠে ডায়াফ্রাম-এর ওপর চাপ দিতে থাকে অনেক সময় বিষয়টা বাড়াবাড়ি রকমের হলে বুকেও ব্যথা হয়। মানে অ্যাসিড উপরের দিকে উঠে বুকে ধাক্কা মারছে এটাই জিইআরডি। এছাড়া খাওয়ার পর অনেকক্ষণ ধরে পেট ভার থাকা কিম্বা খিদে না পাওয়া, একবার খাওয়ার পরে মনে হল হাঁসফাঁস করছে কখনো কখনো গা বমি ভাব বা বমি করে ফেলার মতো সমস্যাও দেখা যায় আর বলাই বাহুল্য এগুলির মূল কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পূজোর সময় অতিরিক্ত খেয়ে ফেলা। দুর্গা পুজোর পরে লক্ষ্মীপূজো দীপাবলি ইত্যাদি তো আছেই। ফলে খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম যে হবে সেটা তো খুব ধ্রুব সত্য তবে তার মধ্যেও একটু সতর্ক হলে ক্ষতি কী!
সমাধান
পুজোর পাঁচ দিন হোক কিংবা লক্ষ্মীপুজো, দীপাবলি রোজ কিন্তু তিন বেলা বাইরে খাবেন না মাঝেমধ্যে ঘরের খাবারের দিকেও একটু নজর ঘোরান। দুবার বাইরে খেলে একবার একটু হালকা খান অথবা বাড়ির তৈরি খাবার খান। এই সময় প্রাতরাশে অনেকেই পছন্দ করেন লুচি-পরোটা খেতে। তবে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ময়দার লুচি না খেয়ে আটা-ময়দা মিশিয়ে লুচি বানাতে পারেন তাতে স্বাদ আর পুষ্টি দুটোই বজায় থাকবে। আর হ্যাঁ দুপুর আর বিকেলে একটু ভারী খাবার খেতে গেলে প্রাতরাশটা একটু কমিয়ে দিলে ক্ষতি কী, চারটে লুচি আর তিনটে পরোটা — এর মধ্যে যদি নিজেকে আটকে রাখতে পারেন তাহলে দেখবেন পরের মিলটা খাওয়ার সময় শরীর হাঁসফাঁস করছে না ।
পরোটা বানানোর সময় সমস্ত কিছু সবজি দিয়ে বানাতে পারেন অথবা ছাতুর পরোটা। মুখ বদলানো হল আবার পুজোর দিনে মুখরোচক মেনু থেকে আপনার শরীর পাবে পর্যাপ্ত পুষ্টি
পুজোর সময়টা অনেকেই খিচুড়ি আর সঙ্গে পাঁচমিশালী তরকারি খেতে ভালোবাসেন। খান তবে খেয়াল রাখবেন তরকারির পরিমাণটা যেন একটু বেশি থাকে এতে করে শরীরে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন মিনারেলস কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন সব যাবে
সকালে রোজ রোজ লুচি -পরোটা খেতে ভালো না লাগলে কোই বাত নেহি। সুজি ও ওটস দিয়ে উপমা বা প্যানকেক বানাতে পারেন। এছাড়া খেতে পারেন ইডলি, ধোসা। সারাদিন ধরে ঘোরার পরিকল্পনা থাকলে ব্রেকফাস্টটা একটু হেভি করুন তাতে পেট অনেকক্ষণ ভর্তি থাকবে।
মিড মর্নিং স্যাক্স হিসেবে রাখতে পারেন মাখনা। নিরামিষ খান যাঁরা পুজো বা লক্ষ্মীপূজো দিন ধোকার ডালনা, ছানার কোপ্তা, পনিরের তরকারি রাখুন। আর যাঁরা আমিষ খান তাঁরা চিকেন বা মাটন রাখতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে কাজু, কিসমিস দেওয়া জাফরানি পোলাও। তবে বলব এই সময় শেষ রাতে চাটনি আর পায়েস একসঙ্গে খাবেন না যেদিন চাটনি খেলেন পায়েসটা সেদিন বাদ দিন। আর যেদিন পায়েস খাবেন সেদিন পাতে চাটনি নেবেন না।
ডায়াবেটিসের সমস্যা রয়েছে যাঁদের তাঁরা কি মিষ্টি খাবেন না?
অবশ্যই খাবেন কিন্তু সতর্ক হয়ে খেতে হবে ।
ছানার সন্দেশ একটার বেশি খাবেন না আর যেদিন মিষ্টি খাবেন সেদিন যদি সকালে মর্নিং ওয়াক করেন তাহলে অন্যান্য দিনের থেকে একটু বেশিক্ষণ হাঁটতে পারলে ভালো। হ্যাঁ মানছি পুজোর সময় এত রুটিন করে চলা অসুবিধে, কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কী! তবে ভাজা মিষ্টি যেমন ল্যাংচা পান্তুয়া ,বোঁদে, অমৃতি বাদ দিন । এগুলো থেকে শরীরের ক্ষতি হয়। আর ডাইবেটিকরা যদি রসগোল্লা খেতে চান তাহলে রসটা চিপে খাবেন।
পুজোয় চলুক খাওয়া দাওয়া আনন্দ ফুর্তি সারা বছরে তো এই একবারই তারপরে আবারও সেই ৩৬৫ দিনের অপেক্ষা। প্রাণ ভরে খান মনে রাখবেন শরীরের নাম মহাশয় যা সওয়াবেন তাই সয়। কাজেই একটু যত্ন নিয়ে খেলে ক্ষতি কি।
টিপস
খাবারে খুব বেশি গ্যাপ দেওয়া চলবে না। তিন ঘন্টা অন্তর অন্তর অল্প অল্প খাবার বারে বারে খেতে হবে, প্রাতরাশ, লাঞ্চ ডিনারে জটিল শর্করা অর্থাৎ খাদ্যশস্য যেমন ভাত রুটি ডালিয়া বা ওটসকে স্টেপল ফুড হিসেবে রাখুন, সঙ্গে প্রোটিন। নিরামিষের জন্য ছানা, সয়াবিন, আমিষের জন্য মাছ, ডিম, সেদ্ধ চিকেন রাখতে পারেন।
যদি মনে হয় ফল একটু খান। সেটা ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম হতে পারে।
মার্জারিন, মাখন, কোল্ডড্রিংস রেডমিট, মিষ্টি, মানে স্যাচুরেটেড ফ্যাট এই সময় এড়িয়ে যাওয়া সব সময় সম্ভব না। তবে একটু সতর্ক হয়ে খেতে পারলে ভালো। সঙ্গে পর্যাপ্ত সালাড খান । খাওয়ার সময় সালাড মাস্ট বিশেষত লাঞ্চ ও ডিনারে অতিরিক্ত নুন খাওয়া বন্ধ করে দিন। রান্নায় যেটুকু নুন দেওয়া হচ্ছে সেটুকুই খান অনেকেরই অভ্যাস আছে খাবারের ওপর অতিরিক্ত নুন সরিয়ে নেওয়া তবে এই অভ্যেস বর্জন করুন ।পুজো ঠাকুর দেখতে বেরোলে একটু টক ঝাল মিষ্টি না হলে মন ভরেনা কিন্তু আচারে যে নুন তা বলে কি আচার খাব না? খাবেন কিন্তু পরিমাণটা বুঝে।
সঙ্গে রাখতে পারেন সিডস জাতীয় খাবার যেমন কুমড়োর বীজ, সূর্যমুখীর বীজ ইত্যাদি। প্রাতঃরাশে ওটসের সঙ্গে মিশিয়ে কিংবা স্যালাডের ওপর ছড়িয়ে অথবা স্মুদি বানিয়ে খেতে পারেন । আগের দিন রাতে আড়াইশো মিলিগ্রাম জলে ফ্ল্যাক্স সিডস, চিয়া সিডস ভিজিয়ে রাখুন পরের দিন সেই জলটা ছেঁকে খেয়ে নিন অথবা টক দইতে কুড়ি-পচিশ মিনিট আগে মিশিয়ে খেতে পারেন।
তথ্য সহায়তা: পম্পা রায়, কনসালটেন্ট ডায়েটিশিয়ান