ঢিলেমি এমন এক জিনিস, যা একবার গায়ের সঙ্গে লেগে গেলে সহজে ছাড়তে চায় না। ওমানের বিরুদ্ধে গ্রুপ লিগের শেষ ম্যাচে ঠিক সেই ঢিলেমিই ভর করেছিল টিম ইন্ডিয়াকে। ভয়টা তখনই ছিল। র্যাঙ্কিংয়ের ২০ নম্বরে থাকা একটা দুগ্ধপোষ্য দলের বিরুদ্ধেই যদি খোঁড়াতে খোঁড়াতে জিততে হয় তা হলে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের সামনে কী হবে? কিন্তু সেই ঢিলেমিকেই সাক্ষী রেখে রবিবাসরীয় দুবাই দেখিয়ে দিল, জয়-বীরুর জুটি যেখানে উপস্থিত, সেখানে গব্বর সিং তো ছাড়ও— পাত্তা পায় না কোনও শত্রুই।
সত্যিই কি নতুন একটা জয়-বীরুর জুটি পেয়ে গেল ভারতীয় ক্রিকেট? আদ্যিকালের গাভাসকর-বিশ্বনাথ থেকে শুরু করে সচিন-সৌরভ হয়ে হালের ‘রো-কো’। সত্যি কথা বলতে ব্যাটিংয়ে জুটির অভাব কখনওই ছিল না এ দেশে। কেউ কেউ আবার ধোনি-যুবরাজের অচর্চিত জুটিকেও তালিকায় টানতে পারেন বৈকি। তবে এঁদের কেউই সম্ভবত নিজের পার্টনারের মনের ততটাও কাছাকাছি পৌছতে পারেননি যতটা পেরেছেন অভিষেক শর্মা এবং শুভমান গিল।
পাঞ্জাবের দুই ‘পুত্তর’-ই একসঙ্গে খেলছেন সেই স্কুল জীবন থেকে। এর পর ভারতের অনূর্ধ্ব ১৯ দল হয়ে টিম ইন্ডিয়ায়। অভিষেক অনায়াসেই দাবি করতে পারেন, তিনি গিলকে ততটাই চেনেন যতটা চেনেন নিজের হাতের তালুকে। একই দাবি ভারতের টেস্ট অধিনায়ক করলেও আপত্তি তোলার উপায় কোথায়? শেষ পর্যন্ত এই বন্ডিং-ই তো এ দিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপের সুপার ফোরের ম্যাচে চালিকাশক্তি হয়ে রইল মেন ইন ব্লু-র। একই সঙ্গে গিল-অভিষেকরা শুধু পাকিস্তানকে হারালেন না। তারা আসলে ঢিলেমি ঝেড়ে ফেলে ফের জাগিয়ে তুললেন টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের।
টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করতে নেমে একের পর এক ক্যাচ মিস। এর শুরুটা করেন খোদ অভিষেকই, মাত্র ২ রানে ফেলেন শেষ পর্যন্ত অর্ধশতরান করে যাওয়া পাক ওপেনার সাহিবজাদা ফারহানকে। এরই সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়া জশপ্রীত বুমরাহ্’র সাদামাটার থেকেও নিম্নমানের বোলিং। ৪ ওভারে এ দিন কোনও উইকেট না নিয়ে ৪৫ রান অকাতরে বিলিয়েছেন বিশ্বের এক নম্বর বোলার। এ সব দেখতে দেখতে স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে যাচ্ছিল, আগের দিন হারলেও কীভাবে টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে থাকা ভারতকে চোখের জলে নাকের জলে করেছে ওমান।
দুবাইয়ের ২২ গজে তখন ক্রমেই জাঁকিয়ে বসছে ভয়টা। এ ঢিলেমি যে বড্ড ছোঁয়াচে, আর সহজে নির্মূল হওয়ারও নয়। একবার যখন জাঁকিয়ে বসেছে, বিশ্বজয়ীদেরও ছাড় দেবে কি? সবথেকে বড় কথা, সবটা দেখেশুনে পাকিস্তান ছেড়ে দেবে কি? এমনিতেই গত রবিবারের ম্যাচের পর ভারত-পাক মহারণ এখন আর কেবল কথার কথা যুদ্ধ নয়। করমর্দনে বিতর্কের জল গত সাতদিনে এতটাই দূর গড়িয়েছে যে এই মুহূর্তে পাকিস্তানের কাছে পরাজয় মানে আসলে তা অপারেশন সিঁদুরের-ই বদনাম। পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যাট-বলের লড়াই মানেও যে সেটা এখন অপারেশন সিঁদুরের-ই অংশ, তা তো প্রকারান্তরে বুঝিয়েই দিয়েছিলেন সূর্যকুমার যাদবরা।
সব মিলিয়েই ১৭২ তাড়া করতে নামা অভিষেক-গিলদের শুধু প্রয়োজনীয় লক্ষ্য অর্জন করলেই চলত না। তার থেকেও বেশি দরকার ছিল একটা ঝাঁকুনির। যা সামনে থাকা চিরশত্রুদের পায়ের তলার মাটি তো সরিয়ে দেবেই, সেই সঙ্গে নাড়িয়ে দিয়ে যাবে নিজেদের শিবিরকেও। আর ঠিক এখানেই অনুঘটকের কাজটা করে গেল জয়-বীরুর আশৈশব বন্ডিং। এক দিকে অভিষেক যখন হাওয়ায় গোলাগুলি ছুঁড়ছেন, তখন গিল মনোনিবেশ করলেন মাঠের ফাঁকফোকর খোঁজায়।
ঝড়ের পূর্বাভাস রান তাড়া করতে নেমে ইনিংসের প্রথম বলেই দিয়েছিলেন অভিষেক। শাহিন আফ্রিদির লেগস্টাম্পের বাইরের শর্ট ডেলিভারি পুল করতে গিয়ে টপ এজ হয়, আর বল কার্যত উইকেট কিপারের মাথার ওপর দিয়েই চলে যায় সীমানার বাইরে। এই দৃশ্য স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে পারেননি বোলার। মুহূর্তের মধ্যেই ক্রিকেটের রণাঙ্গন যেন পরিণত হয় কার্গিলের প্রান্তরে। ভারতীয় ওপেনারের সঙ্গে বাকযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন শাহিন। যদিও তাতে লাভ কিছু হয়নি। যা হওয়ার তা হয়ে গিয়েছিল ওই একটি বলেই। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, এই ঘটনা বিন্দুমাত্র উত্তেজিত করতে পারেনি উল্টো প্রান্তে থাকা শুভমান গিলকে।
শাহিনের সঙ্গে বিবাদই চাগিয়ে দিয়েছিল অভিষেককে। কিন্তু গিল উল্টোদিক থেকে সবটা দেখেও হাঁটেননি বন্ধুর পথে। অভিষেক যেমন হাত চালিয়েছেন, গিলও যে তেমনটা চালাননি তা বলার উপায় নেই। কিন্তু তাঁর শট সিলেকশন ছিল অনেক বেশি সংযত। বলটা গায়ের জোরে শূন্যে মারার থেকে তিনি জোর দিয়েছিলেন টাইমিংয়ে। যা মনে করিয়ে দিচ্ছিল অতীতের বিরাট কোহলিকে। ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটে এভাবেই তো কত ম্যাচ একার হাতে ঘুরিয়েছেন বিরাট। গিলও সেভাবেই ২৮ বলে ১৬৭ স্ট্রাইক রেটে করে গেলেন ৪৭।
উল্টোদিকে প্রায় ২০০ স্ট্রাইক রেটে অভিষেক এ দিন মেরেছেন মোট ৬ টি চার এবং ৫ টি ছক্কা। সেই সুবাদে গড়ে ফেললেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে সবথেকে কম বল খেলে ৫০ টি ছক্কা হাঁকানোর রেকর্ডও। অভিষেক মাত্র ৩৩১ বল নিয়েছেন এই রেকর্ড গড়তে। শুধু আফসোস রয়ে গেল ৩৯ বলে ৭৪ রানের ইনিংসটা পৌঁছল না তিন অঙ্কে। এর জনও কি জয়-বীরুর বন্ডিং-ই দায়ী?
মাত্র ৯.৫ ওভারেই ১০৫ রান তুলে দেন দুই ওপেনার। কিন্তু সেখান থেকেও লক্ষ্যে পৌঁছাতে লেগে গেল আরও ৯ ওভার, খোয়াতে হল ৪ উইকেট। দুবাইয়ের উইকেট এতটাই বিচিত্র যে নতুন ক্রিজে আসা ব্যাটারদের জন্য কাজ মোটেই সহজ হয় না। ভাগ্যিস! শুরুতে ঝড়-তুলে গিয়েছিলেন জয়-বীরু। তা না হলে দেবীপক্ষের সূচনার প্রাক্কালে কী দৃশ্য দেখতে হত তা মা দুর্গাই জানেন।
Abhishek Sharma, Shubhman Gill, Indian Cricket Team, IND Vs PAK, Asia Cup 2025