মেরেকেটে আর পাঁচ দিন। আর তারপরই শুরু বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। বৃহত্তর কলকাতা জুড়ে সর্বজনীন মণ্ডপগুলিতে এখন চলছে ফিনিশিং টাচ। ভিড় টানতে মণ্ডপসজ্জায় যেমন থিমের কারিকুরি, তেমনি প্রতিমাতেও সাবেকিয়ানার পাশাপাশি রয়েছে আধুনিকতা। এককথায় অপেক্ষার প্রহর গোনার কষ্ট, নিমেষে হাল্কা করতে, যা যা দরকার তার সবকিছুই যেন হাজির এক একটা সর্বজনীনে।
উৎসবের এমন আবহে এবছর কিন্তু বড় বেশি করে রাজনৈতিক বার্তাও দেওয়া হয়েছে এক একটি সর্বজনীনে। কারণ বছর ফুরলেই ছাব্বিশের বিধানসভা ভোট বাংলায়। স্বভাবতই ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে রাজনৈতিক আনুগত্যও মিশিয়ে দিয়েছেন সর্বজনীনের উদ্যোক্তারা। তাই কোনও পুজো মণ্ডপে যখন ‘অপারেশন সিন্দুর’ এর ঢক্কানিনাদ, তখন পরিযায়ী হেনস্তা ঘিরে বাঙালি অস্মিতায় শান সর্বজনীনের আর এক মণ্ডপে।
দমদমের জপুর জয়শ্রী ক্লাবের দুর্গাপুজো। এদের পুজোর থিম “বাঙালির সম্মান রক্ষা” এবং “ভিনরাজ্যে বাঙালির হেনস্থা”। পুজো উদ্যোক্তারা, উত্তর ২৪ পরগনা ৬ পরিযায়ী শ্রমিককে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তাঁদের পুজো মণ্ডপ উদ্বোধনের জন্যে। ক্লাব কর্তাদের বক্তব্য, অন্যান্য রাজ্যে বাঙালি শ্রমিকদের কাগজপত্র দেখানোর নামে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং অনেককেই হুমকি দেওয়া হয়েছে যে তাদের আটক করে শিবিরে রাখা হবে। এবারের পুজোয় এগুলিকেই তাই তুলে ধরা হবে।
জপুর জয়শ্রী ক্লাবের প্যান্ডেলের ভেতরে একটি লকআপের প্রতিরূপও তৈরি করা হয়েছে। ফাইবারগ্লাস দিয়ে তৈরি মানব মডেলগুলিকে সেই লকআপে রাখা হবে। এছাড়াও, বাংলা ভাষার উপর আক্রমণকে তুলে ধরতে, প্রতীকীভাবে পাখির খাঁচা ঝুলিয়ে তার ভেতরে বাংলা বর্ণমালা রাখা হবে। জানয়েছেন পুজো কমিটির সভাপতি সঞ্জয় দাস।
অন্যদিকে বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারে পুজোর থিম ‘অপারেশন সিঁন্দুর’। পহেলগাঁও হামলার প্রেক্ষাপটে নারীশক্তি ও সেনাবাহিনীর বীরত্বের প্রতি উৎসর্গীকৃত এদের পুজো মণ্ডপ। থিমের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মণ্ডপ ও প্রতিমা সাজানো হয়েছে। দেবী দুর্গার প্রতিমাও এই থিমের অংশ। সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের পুজো লেবুতলা পার্কের পুজো বলেও পরিচিত।
পার্কের ঢাউস মণ্ডপে মৃন্ময়ী মূর্তির উলটো দিকে রয়েছে বিরাট আকারের একটি দুর্গার মুখ। বোঝানো হচ্ছে দেবী একদিকে যেমন অসুর বিনাশিনী, তেমনই তিনি একজন বিবাহিত নারী, যাঁর সিঁথিতে রয়েছে সিঁদুর। মণ্ডপে পাহাড়ের আদলে তৈরি মণ্ডপে লেজার ও প্রজেকশন লাইট শো-র ব্যবস্থায় তুলে ধরা হবে সেনাবাহিনীর বীরত্ব। পদ্ম কাউন্সিলরের দাবি, দেশাত্মবোধের এমন বীরগাথা দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করবেই।
বাগুইআটির অশ্বিনীনগর বন্ধুমহল তাদের ৪৫তম দুর্গোৎসবে থিম করেছে ‘বাংলা ও বাঙালি’। তবে এই ভাবনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই বলে দাবি করছেন পুজো কমিটির উদ্যোক্তারা। তাঁদের দাবি, ‘বাংলা ও বাঙালি, সমৃদ্ধির আদ্যোপান্ত’। এই থিমের মাধ্যমে ঐতিহাসিক এবং পুরাতাত্ত্বিক ভাবে বাংলা এবং বাঙালির ইতিহাসের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হবে। ছবি আর ভাস্কর্য ব্যবহার করে বাংলায় শাসনকারী বিভিন্ন রাজবংশ, ব্রিটিশ শাসন এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম তুলে ধরার চেষ্টা চলছে।
উত্তর কলকাতায়, দক্ষিণপাড়া যুব পরিষদের পুজো, এবার বন্দে মাতরমের ১৫০ তম বার্ষিকী উদযাপন করছে। দমদমের এই সর্বজনীন পুজোটি স্বাধীনতার ইতিহাসও তুলে ধরেছে তাদের মণ্ডপ সজ্জায়। সাহিত্যসম্রাটের মর্মস্পর্শী সঙ্গীত কে থিম করে স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনাগুলি একটি প্রজেক্টরের সাহায্যে প্রদর্শিত করা হবে এখানে। প্যান্ডেলে ‘মা’ শব্দটির একটি বিশাল কাট আউট স্থাপন করা হয়েছে।
সেই ২০২১ সালে ইউনেস্কো কলকাতা দুর্গাপুজোকে স্বীকৃতি দিতেই পুজো ঘিরে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার প্রথা যেন আরও জোরদার হয়েছে। যা বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে ভিনরাজ্যেও ছড়িয়েছে। এরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি দুর্গাপুজোয় আগে সেভাবে না জড়ালেও এখন কিন্তু সক্রিয়ভাবেই যুক্ত। আর তাই নিয়ে পদ্ম নেতাদের এখন কটাক্ষের মুখে পড়তে হচ্ছে।
রাজ্যের শাসক দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের দাবি, বেশিরভাগ বিজেপি নেতা কোনও দুর্গাপূজা কমিটির সঙ্গে যুক্ত নন। জনসাধারণের সঙ্গে যোগাযোগও হারিয়ে ফেলেছেন। তাঁদের কাছে এটি কেবল নির্বাচনী বিপণন। শীর্ষ নেতারা কেবল ভোট এলেই এরাজ্যে আসেন। কুণালের এমন বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছেন বিজেপি নেতা রাহুল সিনহা। তাঁর বক্তব্য,বিজেপি দুর্গাপূজার সঙ্গে রাজনীতি মেশায় না। তাছাড়া তৃণমূল জানে, যে তাদের শেষ ঘনিয়ে আসছে এবং সেই কারণে প্রতিটি ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ রাজনীতি করে।