দিব্যেন্দু মজুমদার, হুগলি
মাঝে কয়েকটা দিন, তার পরেই শুরু হয়ে যাবে বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গোৎসব। আর সেই উৎসবের আগেই বর্ষা ভিলেন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সমস্ত বাধা-বিপত্তি, বর্ষার চোখরাঙানি উপেক্ষা করে হুগলির তাঁত হাটে উপচে পড়া ভিড় আর একবার প্রমাণ করল উৎসবের কাছে কোনও বাধাই বাধা নয়। সোমবারের রাতের প্রবল বর্ষণে যখন শহর কলকাতা জলে ভাসছে তখন পুজোর আগে শেষ মঙ্গলবার জনজোয়ারে ভাসল হুগলির সুরবালা তাঁত হাট। শুধু ক্রেতাদের মুখেই হাসি নয়, হাসি ফুটল হুগলির বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের তাঁতিদের মুখে।
এক সময় হুগলির বিভিন্ন গ্রামের তাঁত শিল্পীরা চরম আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু হুগলির চুঁচুড়া কারবালা মোড়ে তখন এই তাঁত হাট লড়াইয়ের শক্তি জুগিয়ে ছিল এই তাঁত শিল্পীদের। সে সময় তাঁত শিল্পীরা শাড়ি বানালেও তা কেনার জন্য কোনও ক্রেতা ছিল না। কলকাতার বড় বড় ব্যবসায়ী ও মহাজনরা খুব অল্প দামে তাঁতিদের ঘর থেকে শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়ে প্রচুর পরিমাণে আর্থিক মুনাফা লুটলেও তাঁত শিল্পীরা অন্ধকারের মধ্যে ডুবে যেতে বসেছিলেন। সংসার খরচ চালানো দায় হয়ে পড়েছিল তাদের। তাদের এই আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে সেই সময় হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভার স্থানীয় কাউন্সিলর ইন্দ্রজিৎ দত্ত ও তার পরিবার উদ্যোগ নিয়ে কারবালা মোড়ে এই তাঁত শিল্পীদের জন্য এই তাঁত হাট গড়ে তোলেন। আজকে সেই তাঁত হাটই হুগলির তাঁত শিল্পীদের আলো দেখাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, হুগলির কারবালা মোড়ে দত্ত পরিবারের নিজস্ব আট কাঠা জমির উপর এই সুরবালা দত্ত তাঁতের হাট গড়ে ওঠে। এই দত্ত পরিবারের সদস্য তথা স্থানীয় কাউন্সিলর ইন্দ্রজিৎ দত্ত জানান, তাদের ঠাকুরমা সুরবালা দত্তের নামে কারবালা মোড়ে আট কাঠা জমি ছিল। হুগলির তাঁত শিল্পীরা যখন চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন সেই সময় শান্তিপুর, ফুলিয়া, হাবিবপুর, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, ধনেখালি, বেগমপুর, গুপ্তিপাড়া সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তাঁতিরা এসে তাদের আর্থিক সংকটের কথা তুলে ধরেন। তাই সংসারকে বাঁচানোর তাগিদে তারা যাতে তাদের নিজেদের তৈরি তাঁতের শাড়ি নিজেরাই বিক্রি করতে পারেন তার জন্য একটা বসার জায়গা করে দেওয়ার আবেদন জানান। ইন্দ্রজিৎ বাবু জানান, সে সময় তাঁত শিল্পীদের এই দুরবস্থা তার মনকে রীতিমতো ভারাক্রান্ত করে তুলেছিল। তাই তাঁত শিল্পীদের লড়াইয়ের সঙ্গী হয়ে হুগলি-চুঁচুড়া পুরসভার অনুমোদন সাপেক্ষে ২০১৭ সালে তার ঠাকুমা সুরবালা দত্তের নামে থাকা ফাঁকা ওই জমিতে প্রথমে বাঁশের কাঠামোর উপর ত্রিপলের ছাউনি দিয়ে তাঁতিদের বসার জায়গা করে দেন। পরবর্তীকালে লোহার রডের কাঠামো তৈরি করে তার উপর টিনের শেড দিয়ে হাট বসানোর পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা হয়। প্রতি মঙ্গলবার এই হাট বসে। বিনিময়ে ইলেকট্রিক খরচ ও হাটকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রত্যেক মঙ্গলবারের জন্য কুড়ি টাকা করে দেন তাঁত শিল্পীরা। করোনাকালে তাঁত শিল্পীদের রোজগার তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এই হাটকে কেন্দ্র করেই হুগলির বিভিন্ন প্রান্তের তাঁত শিল্পীরা অনেকেই আর্থিক সংকট কাটিয়ে উঠেছেন।
শান্তিপুর, ফুলিয়া, ধনেখালি, বেগমপুরের তাঁত শিল্পীরা জানিয়েছেন, বর্তমানে মোট ১১০ জন তাঁত শিল্পী তাদের নিজের হাতে তৈরি করা বিভিন্ন ধরনের শাড়ি এই হাটে বিক্রি করেন। ঢাকাই জামদানি থেকে শুরু করে টাঙ্গাইল, বালুচরী সহ বিভিন্ন ধরনের তাঁতের শাড়ি তারা বিক্রি করেন। তারা আরও জানান, তাদের ঘর থেকে ক্রেতারা শাড়ি নিয়ে গেলে অনেক সময় ধার বাকি রেখে যান। সেখানে এই তাঁত হাটে সমস্তটাই নগদে কেনাবেচা হয় বলে লোকসানের সম্ভাবনা প্রায় নেই। তাছাড়া বর্তমানে হুগলি ছাড়াও কলকাতা থেকে বহু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মঙ্গলবার করে এই তাঁত হাটে ছুটে আসেন।
হুগলির এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অনন্ত কর্মকার জানান, এখানে তাঁতিরা তাদের নিজের হাতে তৈরি শাড়ি সরাসরি বিক্রি করেন বলে তাদের কাছ থেকে অনেকটা কম দামে কিনতে পারেন। এবং সেই শাড়ি কিনে নিয়ে গিয়ে তাদের পক্ষেও লাভের মুখ দেখা অনেকটা সহজ হয়। কারণ তারা যে দামে শাড়ি বিক্রি করেন কলকাতার যে কোনও বড় ব্যবসায়ী সেই শাড়ি অন্তত দুই থেকে তিন গুণ দামে বিক্রি করেন। সে ক্ষেত্রে শুধু তাঁতিরা নন, তাদের মতো ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন। সোমবারের প্রবল বৃষ্টির চোখরাঙানিকে উপেক্ষা করেই এদিন এই তাঁতের হাটে উপচে পড়েছিল ভিড়। বিক্রিবাটার বহরও নেহাত কম ছিল না। অন্যদিকে সমস্ত বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে ক্রেতারাও এদিন হাটমুখী হয়েছিলেন। শ্রীরামপুর উত্তরপাড়ার মৌসুমী সরকার, পিয়ালী ব্যানার্জি সহ অন্যান্য মহিলারা জানান, তারা গত তিন বছর ধরে এই হাট থেকেই পুজোর বাজার করে নিয়ে যাচ্ছেন। অনেক সময় পুজোর আগে এসে তারা পছন্দমতো শাড়ির অর্ডারও দিয়ে যান তাঁতিদের কাছে। তাছাড়া অনুষ্ঠান বাড়ি বা বাড়িতে কোনও বিয়ের অনুষ্ঠান থাকলে তারা এখান থেকেই শাড়ি কিনে নিয়ে যান। তারা আরও জানান, কলকাতায় যাতায়াতের ঝক্কি অনেক। সেখানে হুগলির এই হাট তাদের কাছে অনেক বড় পাওনা। একদিকে আকাশের মুখ যখন ভার, তখন পুজোর আগে শেষ মঙ্গলবারের এই হাট একদিকে ক্রেতাদের মুখে যেরকম হাসি ফুটিয়েছে অন্যদিকে হাসি ফুটেছে তাঁত শিল্পীদের মুখেও।