বিহারের রাজনীতিতে জাতই দিক নির্দেশক এবং একই সঙ্গে ফাঁদও বটে। প্রতিটি ভোটার, প্রতিটি দল, প্রতিটি প্রতিশ্রুতি সেই জাতভিত্তিক সমীকরণের উপর দাঁড়িয়ে। এর মধ্যে সবচেয়ে অস্থির উপাদান কিন্তু নির্ণায়ক শক্তি হল অতি অনগ্রসর শ্রেণি (ইবিসি)— তাঁরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৬ শতাংশ।
মিথিলাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় এদের বলা হয় পঞ্চফোর্না বা পঞ্চপানিয়া। তাঁরা না যাদবদের মতো রাজনীতির কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক, না দলিতদের মতো স্থায়ী পদাতিক বাহিনী। বরং তাঁরা সুইং ভোট, যাঁদের হাতেই ক্ষমতার পাল্লা ওঠানামা করে।
দুই দশক ধরে নীতীশ কুমার নিজেকে তাঁদের অভিভাবক হিসেবে তুলে ধরেছিলেন। অতি অনগ্রসর স্কিম, ছাত্রীদের জন্য সাইকেল প্রকল্প, পঞ্চায়েতে এক-তৃতীয়াংশ আসনে সংরক্ষণ—এসবই ছিল নীতীশের কৌশল, যাতে নোনিয়া, তেলি, মল্লাহ, ধানুক, অমাত্যের মতো ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীগুলিকে মর্যাদা দিয়ে নিজের ভোটব্যাঙ্কে রূপান্তর করা যায়। এর ফলও মিলেছিল।
২০১০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই শ্রেণির প্রায় ৪৫-৫০% ভোট যায় জেডিইউ-বিজেপি জোটের পক্ষে। ২০১৫ সালে, লালু প্রসাদ যাদবের সঙ্গে মহাগঠবন্ধনে গেলে, এদের ৫৫% এর বেশি ভোট জোটের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কিন্তু ২০২০ সালে আবার মোড় ঘুরে যায়—প্রায় ৪৫% ভোট পড়ে এনডিএ-র ঝুলিতে, মহাগঠবন্ধন পায় এক-তৃতীয়াংশের মতো।
অর্থাৎ, গত এক দশকে অতি অনগ্রসর শ্রেণীর ভোটাররা প্রত্যেক নির্বাচনে আনুগত্য বদলেছেন—তাঁরাই ভাসমান ভোটার, বিহারের রাজনীতির আসল কিংমেকার।
কিন্তু আজ নীতীশের অবস্থান নড়বড়ে। সঙ্গী ও প্রতিপক্ষের মধ্যে দোদুল্যমান তিনি যেন আর কাণ্ডারী নন, বরং নিজেই ভেসে চলা এক চরিত্র। এই ফাঁকেই নতুন সুযোগ দেখছেন রাহুল গান্ধী। তাঁর জাতিগত জনগণনা দাবি, “৩৬ শতাংশ”-এর প্রতি বারবার উচ্চারণ—সবই নীতীশের পুরনো দুর্গে থাবা বসানোর চেষ্টা। সদাকত আশ্রমে কংগ্রেস কর্মসমিতির বৈঠকেও তিনিও মহাগঠবন্ধনের অংশীদারেরা এই ভোট ব্যাংকের জন্য বিশেষ উদ্যোগের বার্তা দিয়েছেন।
কর্পুরি ঠাকুরের সংরক্ষণ নীতি সর্বপ্রথম এদের জায়গা করে দিয়েছিল উচ্চবর্ণ আধিপত্যের বিরুদ্ধে। লালু প্রসাদের মণ্ডল রাজনীতি তাদের যাদব নেতৃত্বাধীন ছাতার নিচে টেনে আনে। নীতীশ কুমার এই শ্রেণিকে নীতি-পরিকল্পনার আলোয় তুলে ধরেন। আর আজ রাহুল গান্ধী তাঁদের জাতীয় বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রে বসাতে চাইছেন।
তবুও, স্থায়ী নেতৃত্ব বা অভিন্ন পরিচয় না থাকার কারণে তাঁদের ভোট সবসময় ভাসমান থেকেছে। কিন্তু সেই ভাসমানতাই তাঁদের শক্তি। ২০১০-এ তাঁরা নীতীশকে মসনদে বসিয়েছিলেন, ২০১৫-তে লালু-নীতীশ জোটকে, আর ২০২০-তে আবার এনডিএ-কে।
তাই বিহারের রাজনীতির কাহিনি রচিত হচ্ছে তাঁদের দ্বারাই, যাঁদের মানচিত্র এখনও এক রেখায় আঁকা যায়নি। অতি অনগ্রসর শ্রেণীর ভোটাররা—যাঁদের একসময় উপেক্ষা করা হত—এখন তাঁরাই প্রতিটি রাজনৈতিক কৌশলবিদের মূল নজরে। তাঁদের ভেসে চলাই হয়তো ঠিক করে দেবে, আগামী দিনে পাটনায় ক্ষমতার নোঙর কার হাতে বাঁধা থাকবে।