শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বঘোষিত ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ। দিল্লি পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজছে স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতী ওরফে পার্থসারথি নামের বছর ৫২-র এক পলাতক অভিযুক্তকে। রাজধানী নয়াদিল্লির বসন্ত কুঞ্জ এলাকায় শ্রী সারদা ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ান ম্যানেজমেন্ট নামে এক বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এই স্বঘোষিত ধর্মগুরু। অভিযুক্ত দেশ ছেড়ে যাতে পালাতে না পারে সেজন্য লুক আউট নোটিসও জারি করা হয়েছে।
স্বঘোষিত ধর্মগুরু নিজেকে ম্যানেজমেন্ট গুরু এবং লেখক হিসাবে তুলে ধরতেন। তাঁর প্রোফাইলে উল্লেখ রয়েছে একগাদা দেশ ও বিদেশের ডিগ্রি। দাবি করতেন সাত-সাতটি সাম্মানিক ডি লিটও তিনি পেয়েছেন। এ হেন শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ এনেছেন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১৭ নিগৃহীত ছাত্রী। আর সেই অভিযোগ দায়ের হতেই ম্যানেজমেন্ট গুরুর দেশ-বিদেশের ডিগ্রি ঘিরেও তথ্য-তালাশ চালাচ্ছেন তদন্তকারী দলের সদস্যরা।
দিল্লি পুলিশ সূত্রে খবর, এই স্বঘোষিত ম্যানেজমেন্ট গুরু তার ছাত্রীদের নিয়মিত অশ্লীল মেসেজও পাঠাতেন হোয়াটসঅ্যাপে। টার্গেট করা ছাত্রীদের সম্বোধন করতেন ‘বেবি’ বলে। ছাত্রীদের কখনও ‘আই লাভ ইউ’, কখনও আবার ‘আই অ্যাডোর ইউ’ লিখেও পাঠিয়েছেন। ছাত্রীদের আরও অভিযোগ, স্বামী চৈতন্যানন্দ কখনও তাঁদের দেহের গড়ন, কখনও সাজ-পোশাক, কখনও আবার চুল নিয়ে প্রশংসা করে কু-ইঙ্গিত করেছেন। ছাত্রীদের কাছে পাঠানো সেই সব মেসেজ এখন তদন্তকারী পুলিশকর্তাদের হাতে।
এফআইআর দায়ের করার সময় এক নিগৃহীত ছাত্রী লিখেছেন, গত বছরের অক্টোবরে তিনি দিল্লির ওই ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছিলেন। ছাত্রীর অভিযোগ, দিওয়ালির সময় তাঁকে প্রথম ডেকে পাঠান স্বামী চৈতন্যানন্দ। প্রথম সাক্ষাতের সেই অভিজ্ঞতা তাঁর কাছে ছিল “strange” and “demotivating”। অভিযোগপত্রে ছাত্রী আরও উল্লেখ করেছেন, ডিসেম্বর মাসে হস্টেলে পড়ে গিয়ে তাঁর পায়ের হাড়ে চিড় ধরে। বিষয়টি জেনে ম্যানেজমেন্ট গুরু এক্স রে রিপোর্ট চেয়ে পাঠান। হোয়াটসঅ্যাপে সেই রিপোর্ট পাঠানোর পর থেকে তার কাছে আসতে থাকে বিভিন্ন কু-ইঙ্গিত এবং কদর্য ভাষায় লেখা মেসেজ।
মেসেজের উত্তর না দিলে পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হত বলেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। নিগৃহীত আরও এক ছাত্রীর অভিযোগ, ২০২৫ সালের মার্চে একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অছিলায় তাঁকে নিজের কোয়ার্টারে ডেকে পাঠিয়েছিলেন অভিযুক্ত স্বামী চৈতন্যানন্দ। রাতে মেসেজ করে দেখা করার জন্য জোরাজুরিও করেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তিন মহিলা কর্মীর বিরুদ্ধেও অভিযোগ তুলেছেন ওই ছাত্রী।
এফআইআর-এ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্বেতা, ভাবনা এবং কাজল নামের তিন মহিলা কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। লেখা হয়েছে তারা জোর করে অভিযোগকারীকে স্বামীজির পাঠানো কু-ইঙ্গিতের মেসেজগুলি মুছে ফেলার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। একই সঙ্গে ক্ষমা চেয়ে ইমেল করতেও বাধ্য করিয়েছেন। দিল্লি পুলিশের তদন্তকারীদের একটি সূত্র বলছে, স্বঘোষিত স্বামীজির এই কুকীর্তি গত ১৬ বছর ধরেই চলছে। কমবেশি ৫০ জন ছাত্রীর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ এবং ফোনের রেকর্ড ঘেঁটে বেশ কিছু তথ্যও উদ্ধার করা হয়েছে।
দিল্লি পুলিশের কাছে জমা পড়া এফআইআর অনুসারে, হোলির সময়েও এক ছাত্রীর নিগৃহের অভিযোগ জমা পড়েছে। লেখা হয়েছে, ছাত্রীদের লাইনে দাঁড় করিয়ে স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতীর গায়ে রং লাগাতে বাধ্য করা হয়েছিল। নিগৃহীতার অভিযোগ, তাঁকে অফিসে ডেকে পাঠানো হয়েছিল, যেখানে স্বামীজি জোর করে একটি ভিডিয়ো রেকর্ড করেছিলেন এবং আপত্তিকর মন্তব্য করেছিলেন।
জমা পড়া অভিযোগের মধ্যে রয়েছে ২০২৫ সালের জুন মাসে হৃষীকেশ ভ্রমণের একটি ঘটনা। বেশ কয়েকজন নিগৃহীত ছাত্রীর দাবি, সেই সময় তাঁদের যখন তখন ডাকা হয়েছিল এবং শ্লীলতাহানির শিকার হতে হয়েছিল। যাঁরা প্রতিরোধ করেছিলেন, তাঁদের পরীক্ষায় বসতে বাধা দেওয়া হয়েছে কিংবা তাঁদের নম্বর কমিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলে অভিযোগ।
গা ঢাকা দেওয়া স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতীর বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ অবশ্য নতুন নয়। পুলিশের রেকর্ডে ধরা পড়েছে স্বঘোষিত ধর্মগুরু ২০০৯ এবং ২০১৬ সালেও শ্লীলতাহানির ঘটনায় অভিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ার সুবাদে কোনও বারই সাজা ভোগ করতে হয়নি। আগের রেকর্ড ঘেঁটে এবার আটঘাট বেঁধেই তদন্তে নেমেছে দিল্লি পুলিশ।
আগস্টের শুরুতে ডিফেন্স কলোনি থানায় অভিযোগ দায়ের হওয়ার পর থেকেই ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উধাও হয়ে যান স্বামী চৈতন্যানন্দ সরস্বতী। সেই সময় অভিযুক্ত লন্ডনে ছিলেন বলে শুরুতে ধারণা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে সূত্র মারফত তার হদিশ মেলে আগ্রায়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। দিল্লি হাইকোর্ট থেকে আগাম জামিনের আবেদনও করেছিলেন অভিযুক্ত। কিন্তু পরে সেটি প্রত্যাহার করে নেন। অভিযুক্তকে পাকড়াও করতে দিল্লি পুলিশ তখন থেকেই দিল্লি সহ হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড এবং রাজস্থান জুড়ে তাদের তল্লাশি অভিযান জারি রেখেছে।