২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫ শুক্রবার, ভারতীয় বায়ুসেনার ইতিহাসে এক যুগের অবসান ঘটল। সোভিয়েত যুগের বিখ্যাত যুদ্ধবিমান মিগ-২১, যা দীর্ঘ ছয় দশক ধরে ভারতের আকাশ রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছে, অবশেষে আজ তার শেষবারের মতো উড়ল। পাকিস্তানের সঙ্গে চার-চারটি যুদ্ধে ভারতবাসীকে গর্বিত করেছে এই জেটের বীরত্ব গাথা।
আজ দুপুর ১২টা ০৫ মিনিটে চণ্ডীগড়ের আকাশে ছয়টি মিগ-২১ ‘বাইসন’ ভ্যারিয়েন্ট শেষবারের মতো উড়বে। নেতৃত্ব দেবেন এয়ার চিফ মার্শাল এ.পি. সিং। অবতরণের পর এই জেটগুলিকে বিশেষ ‘ওয়াটার ক্যানন স্যালুট’ দিয়ে সম্মান জানানো হবে।
চণ্ডীগড়েই বিদায় অনুষ্ঠানের আয়োজনের কারণ হিসেবে জানা গিয়েছে যে, ১৯৬৩ সালে এখানেই প্রথমবার ভারতীয় বায়ুসেনায় মিগ-২১ অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সেবছর ১৩টি জেট ভারতীয় বাহিনীতে যোগ দেয়, যাদের প্রধান কাজ ছিল উচ্চ-উচ্চতায় মার্কিন ইউ-২ স্পাই প্লেন প্রতিরোধ।
আজকের বিশেষ উড়ানে এয়ার চিফের সঙ্গে রয়েছেন স্কোয়াড্রন লিডার প্রিয়া শর্মা, ভারতের সপ্তম মহিলা ফাইটার পাইলট। তিনি রাজস্থানের বিকানের থেকে মিগ-২১ চালিয়ে চণ্ডীগড়ে এসে এয়ার চিফের সঙ্গে ফরমেশনে অংশ নেন। তাঁর উপস্থিতি প্রমাণ করল, মিগ-২১ শুধু যুদ্ধক্ষেত্রেই নয়, প্রজন্মকে শক্তিশালী করার প্রতীকও। নতুন প্রজন্ম এখন রাশিয়ার সুখোই এসইউ-৩৭ ও ফ্রান্সের রাফালে উড়াচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের শুরুর শিক্ষা সেই মিগ-২১ থেকেই। আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত হচ্ছেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ও বায়ুসেনার বহু শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা।
উল্লেখ্য, ১৯৬৩ সালের এপ্রিল মাসে ভারতীয় বায়ুসেনায় প্রথম মিগ-২১ আসে। এরপর প্রায় ১,২০০টি মিগ-২১ বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্ট মিলে ভারতের আকাশরক্ষার মেরুদণ্ডে পরিণত হয়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত ভারতীয় বায়ুসেনাকে অনেকে মজা করে ‘মিগ এয়ার ফোর্স’ বলতেন, কারণ একসঙ্গে মিগ-২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯, পাঁচটি ভ্যারিয়েন্ট পরিষেবায় নিযুক্ত ছিল।
মিগ-২১ শুধু আকাশযুদ্ধেই নয়, স্থল আক্রমণ, নজরদারি, এমনকি পাইলটদের প্রশিক্ষণেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নাইটি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিমান আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও অ্যাভিওনিক্সে আপগ্রেড হয়ে ওঠে ভারত-রাশিয়ার সামরিক সহযোগিতার প্রতীক।
তবু শেষ জীবনে এই বিমান পেয়েছিল এক দুঃখজনক উপাধি ‘ফ্লাইং কফিন’। ক্রমশ বেড়ে ওঠা দুর্ঘটনার কারণে মিগ-২১-এর ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে। ২০২৩ সালের মে মাসে রাজস্থানের হনুমানগড়ে এক মিগ-২১ দুর্ঘটনায় তিনজন গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। বিমানটি সুরতগড় ঘাঁটি থেকে রুটিন অনুশীলনে উড়েছিল, কিন্তু ‘প্রযুক্তিগত ত্রুটি’র কারণে ভেঙে পড়ে। সেই ঘটনার পর পুরো মিগ-২১ বহর সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। তবে এই নেতিবাচক নামের আড়ালে চাপা রয়েছে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। ৩০০-র বেশি দুর্ঘটনা ও বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে এখন মিগ-২১কে বিদায় জানানোর সময় এসেছে।
আজকের দিনটি তাই শুধুই এক বিমানের অবসর নয়, বরং ভারতীয় বায়ুসেনার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটল। মিগ-২১-এর জায়গায় আসছে এবার দেশের নিজস্ব তেজস ফাইটার জেট, যা ভবিষ্যতের আকাশযুদ্ধের দায়িত্ব নেবে। আজ মিগ-২১ সত্যিই উড়ে গেল সূর্যাস্তের পথে। পড়ে রইল ছয় দশকের বীরত্বের কাহিনি।