স্নিগ্ধা চৌধুরী
নবরাত্রির প্রতিটি দিন দেবী দুর্গার একেকটি রূপকে উৎসর্গ করা হয়। এর মধ্যেই পঞ্চম দিন সর্বাধিক তাৎপর্যময়, কারণ এই দিনে পূজিত হন মা দুর্গার স্কন্দমাতা রূপ। পৌরাণিক কাহিনির গভীরে গেলে দেখা যায়, দেবীর এই রূপ শুধুমাত্র মাতৃত্বের প্রতীক নয়, বরং যুদ্ধ ও জয়ের আদি উৎস। বলা হয়, অসুররাজ তারকাসুরকে বধ করা সম্ভব ছিল কেবলমাত্র মহাদেবের পুত্রের দ্বারা। তখনই দেবী পার্বতী মাতৃত্বের স্নেহে পরিণত হন শক্তির উৎসে, তিনি নিজের পুত্র কার্তিকেয়কে যুদ্ধবিদ্যায় প্রশিক্ষিত করার জন্য গ্রহণ করেন স্কন্দমাতার রূপ। এই রূপের মূলে রয়েছে এক অনন্য বৈপরীত্য। একদিকে কোমল মাতৃস্নেহ, অন্যদিকে ভয়ঙ্কর যুদ্ধশক্তি। মা তাঁর সন্তানকে শুধু স্নেহই দেননি, দিয়েছেন কর্তব্যবোধ, শত্রু দমন করার অদম্য শক্তি এবং দেবোত্তম সাহস। ভগবান কার্তিকেয় সেই মাতৃশক্তির কাছে শিক্ষা গ্রহণ করে অসুররাজ তারকাসুরকে পরাজিত করেছিলেন। তাই দেবী দুর্গার এই রূপ কেবল মা হিসেবে নয়, শক্তির সঞ্চারিণী হিসেবেও পূজিত হন।
পৌরাণিক কাহিনি বলছে, পার্বতী যেহেতু হিমালয়ের কন্যা, তাই তিনি পরিচিত হন পার্বতী নামে। তাঁর শ্বেতবর্ণ রূপে তিনি গৌরী, আবার মহাদেবের পত্নী বলে তিনি মহেশ্বরী। কিন্তু সন্তান কার্তিকেয়কে সামনে রেখে তিনি যখন দেবীশক্তির ধারক, তখন তিনি স্কন্দমাতা। মায়ের এই নামকরণেই লুকিয়ে আছে গভীর সত্য। সন্তানের নামেই মায়ের পরিচয়, কারণ মা কখনও নিজের থেকে বড় হয়ে ওঠেন না, সন্তানের সাফল্যেই তিনি পূর্ণতা খুঁজে পান।
স্কন্দমাতার প্রতিমায় সাধারণত তাঁকে পদ্মাসনে বসা অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর চারটি হাতের মধ্যে দুটি হাতে পদ্মফুল, এক হাতে আশীর্বাদের ভঙ্গি এবং অন্য হাতে থাকে শিশু স্কন্দ। প্রতিমার এই রূপেই ফুটে ওঠে মাতৃত্ব ও শক্তির যুগলবন্দি। পদ্মফুল শান্তি, জ্ঞান ও পবিত্রতার প্রতীক, আর আশীর্বাদের ভঙ্গি জানিয়ে দেয় যে ভক্তদের তিনি সর্বদা রক্ষা করেন।
বিশ্বাস করা হয়, যে ভক্ত নিষ্ঠা ও ভক্তিভরে স্কন্দমাতার পূজা করেন, তাঁর জীবনে আসে সন্তানের সুখ, সমৃদ্ধি ও নিরাপত্তা। সন্তানহারা মায়েরা সন্তানের কামনায় স্কন্দমাতার কাছে প্রার্থনা করেন। আবার যাঁরা জীবনে বাধা-বিপত্তি পেরোতে চান, তাঁরাও মায়ের এই রূপে শক্তি খুঁজে পান। কারণ এই রূপই শেখায় যখন মাতৃত্বের সঙ্গে মিলিত হয় শক্তি, তখন জন্ম নেয় অজেয়।
নবরাত্রির পঞ্চম দিনে তাই শুধু পূজাই নয়, স্কন্দমাতার কাহিনি পাঠ বা শ্রবণ করাকেও বিশেষ শুভ বলে মনে করা হয়। কারণ দেবীকে স্মরণ করার সঙ্গে সঙ্গে স্মরণ করা হয় সেই মাতৃস্নেহের গল্প, যেখান থেকে জন্ম নিয়েছিল দেবশক্তির সর্বোচ্চ প্রকাশ।
মাতৃত্বের কোমল স্পর্শ থেকে যে শক্তির স্রোত বয়ে যায়, স্কন্দমাতা সেই চিরন্তন সত্যের মূর্ত প্রতীক। তিনি শুধু সন্তান কার্তিকেয়কে নয়, ভক্তদের প্রতিও সমান দায়বদ্ধ। তাঁর আশীর্বাদে যেমন সন্তান রক্ষিত হয়, তেমনই পরিবারে আসে শান্তি ও ঐশ্বর্য।
তাই পঞ্চমীর পূজা শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এক আধ্যাত্মিক উপলব্ধি। মা দুর্গার স্কন্দমাতা রূপ মনে করিয়ে দেয়, একজন মা যদি চান, তবে তাঁর স্নেহই হয়ে উঠতে পারে অশুভ বিনাশের অগ্নিশক্তি। আর সেই শক্তির জয়ধ্বনি যুগ যুগ ধরে প্রতিধ্বনিত হয়েছে মহাকাব্যে, পৌরাণিকে এবং আজও শারদীয় উৎসবের উজ্জ্বল প্রাঙ্গণে।