স্নিগ্ধা চৌধুরী
পুরাণসাগরে আলোড়ন তোলে দেবী কাত্যায়নীর আবির্ভাবকথা। তিনি দুর্গার নবদুর্গারূপের ষষ্ঠ, মহাশক্তির দীপ্ত অগ্নিশিখা, দেবতাদের তেজে রূপসিদ্ধা জগন্মাতা। সোনালি আভায় দীপ্ত, চতুর্ভুজা দেবী ডানদিকে উপরের হাতে অভয়, নিচের হাতে বরমুদ্রা, বাম হাতে প্রস্ফুটিত পদ্ম আর তলোয়ার, আর তার বাহন সিংহ যেন দেবীর দুর্জয় সাহসের প্রতিমূর্তি। এই রূপে তিনি একইসঙ্গে দিব্যসুন্দরী ও ভীষণা যুদ্ধদেবী, একদিকে শান্তির অমৃতধারা, অন্যদিকে অসুরনাশিনী অগ্নিকণা।
ঋষি কাত্যায়নের দীর্ঘ তপস্যা, দগ্ধ হৃদয়ের আর্তি আর অন্তহীন ব্রহ্মচিন্তনের প্রতিদান স্বরূপ জন্ম নেন দেবী। ঋষির আকাঙ্ক্ষা ছিল, দুর্গা যেন তার কন্যারূপে জন্ম নিয়ে আশীর্বাদ করেন। দেবী সম্মত হলেন, তাঁর গৃহে অবতীর্ণ হলেন কন্যা হয়ে। তাই মহাশক্তি কাত্যায়নী ঋষির নামেই খ্যাত হলেন জগতে।
যখন মহিষাসুরের অত্যাচারে দেবলোকে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছে, দেবগণ ভগবতীকে আহ্বান করলেন। অসুরের বর ছিল, মাতৃগর্ভজাত নারী ছাড়া আর কেউ তাকে বধ করতে পারবে না। তখন দেবতাদের সম্মিলিত তেজে সৃষ্টি হলেন এক অনন্যা নারী, কায়ারূপিণী তামসী শক্তি, যিনি আসলে দুর্গারই রূপ, তিনি কাত্যায়নী। তাঁর হাতে তলোয়ার ঝলসে উঠল, সিংহগর্জন ধ্বনিত হল, আর মহিষাসুর পতিত হলেন রণমুখে। এই মহাসংগ্রাম হয়ে উঠল চিরন্তন সাহসের প্রতীক, আর সেই থেকেই কাত্যায়নী পূজা হল সর্বব্যাপী।
প্রাচীন বেদে, তৈত্তিরীয় আরণ্যকে প্রথম তাঁর উল্লেখ মেলে। পতঞ্জলির মহাভাষ্যে তিনি আদিশক্তি নামে প্রসিদ্ধ। পরে দেবীমাহাত্ম্য ও দেবীভাগবত পুরাণে তাঁর মহিমা লিপিবদ্ধ হয়, যেখানে তিনি শুধু অসুরবধকারিণী নন, ভক্তের অভয়দাত্রী, মুক্তির পথপ্রদর্শক। বৌদ্ধ, জৈন ও তন্ত্রগ্রন্থেও তাঁর গৌরবগাথা প্রতিধ্বনিত, আর কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে উড্ডীয়ন বা ওড়িশা তাঁর এক প্রধান ক্ষেত্র।
লোকবিশ্বাসে তাঁর গাত্রবর্ণ রক্তকমলসম, দেহ দীপ্ত লালাভ, যা শক্তি ও উগ্রতার প্রতীক। তবে তিনি শুধু উগ্র নন, তিনি আবার করুণার সাগর। যোগতন্ত্রে তিনি আজ্ঞাচক্রের অধিষ্ঠাত্রী, যেখানে সাধক মনোনিবেশ করলে পান অসীম আশীর্বাদ। দেবী ভক্তকে দান করেন বিষ্ণুভক্তি, আর সেই ভক্তি থেকে উন্মোচিত হয় ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের চতুর্বিধ ফল। তাঁর কৃপায় মুছে যায় ভয়, শোক আর রোগবালা, ভক্ত হয়ে ওঠে অলৌকিক তেজে পরিপূর্ণ।
শাক্তধর্মে তিনি ভদ্রকালী ও চণ্ডীর সমরূপা, আবার তিনি জননী, যিনি ভক্তকে বক্ষে আশ্রয় দেন। রণরঙ্গে তিনি দুর্জয়, মহিষাসুরবধিনী, কিন্তু ভক্তিরসিকের কাছে তিনি অনুগ্রহস্বরূপিণী। তাই কাত্যায়নী কেবল শক্তির প্রতিমূর্তি নন, তিনি প্রেম, ভক্তি, আর মুক্তির আলোকশিখা।
দেবী কাত্যায়নী সেই চিরন্তন রূপ, যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রলয়স্বরূপা, আবার ভক্ত হৃদয়ে দিব্যশান্তির সুধাধারা। ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে আবির্ভূত হয়ে তিনি আজও অরুণোদয়ের মতো আলোকিত করেন ভক্তসমাজকে। তাঁর নাম উচ্চারণে জাগে সাহস, তাঁর পূজায় মেলে অভয়, তাঁর কৃপায় উন্মুক্ত হয় মুক্তির দ্বার। তিনি অনন্ত, তিনি মহাশক্তি, তিনি কাত্যায়নী।