দুর্গাপুজো ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য নজির গড়ছেন ওড়িশা ময়ূরভঞ্জ জেলার বারিপদার কোহিনুর ইসলাম। ৭৬ বছর বয়সী এই মুসলিম বাসিন্দার উদ্যোগেই, এবার নিয়ে একটানা ৪০ বছর ধরে হচ্ছে তেঁতুলিডিঙ্গা গ্রামের সর্বজনীন দুর্গাপুজো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে গ্রামের প্রতিটি মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসা এবং বিশ্বাস তাঁকে শারদোৎসব শুরু করার সাহস জুগিয়েছে।
বারিপদা শহর লাগোয়া গ্রাম তেঁতুলিডিঙ্গা। সেই ১৯৮৬ সালে নিজেদের গ্রামেই দুর্গাপুজো করার জন্য গ্রামবাসীদের কাছে প্রস্তাব পাড়েন বছর ৩৫-এর কোহিনুর। কেন দুর্গাপুজোর আয়োজন করতে চান তার কারণও সবিস্তারে বলেন। ভিন্ন ধর্মের প্রতিবেশীর কাছ থেকে দুর্গাপুজো করার প্রস্তাবটি মনে ধরেছিল কাছে-পিঠের হিন্দু বাসিন্দাদেরও। শুরুতে দুই সম্প্রদায়ের ২৫ টি পরিবার একত্রিত হয়ে সেই ১৯৮৬ সালেই তেঁতুলিডিঙ্গায় শুরু করে দুর্গাপুজো। যা আড়ে-বহরে বেড়ে আজও চলছে।
”এলাকার অনেক মহিলাকে (হিন্দু) সেই বারিপদা শহরে ভোর ভোর যেতে দেখতাম পূজা দেখতে। সেখানে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়াই হোক কিংবা ‘সন্ধি পূজা’ দেখা বা সিঁদুর খেলাতেও সামিল হতেন তাঁরা। আচার-অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়িতে ফিরতে তাঁদের অনেকটাই রাত হত। এখন নিজেদের গ্রামে পূজা হওয়ায় আর তাঁদের বারিপদায় যেতে হয় না।” সর্বজনীনের হাজারো কাজ সামাল দেওয়ার ফাঁকে বলেছেন কোহিনুর ইসলাম।
গ্রামবাসীদের অনুদানে গড়া তহবিল এবং শুভানুধ্যায়ীদের সাহায্যেই দুর্গপুজো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে তেঁতুলিডিঙ্গা সর্বজনীনের। ৪০তম বর্ষের পুজোয় সদস্যসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০০। তবে এখনও পুজো কমিটির প্রধানের দায়িত্ব সামাল দিয়ে চলেছেন বছর ৭৬-এর কোহিনুর ইসলাম।
পুজোর কাজে তাঁর প্রধান সহায় নিজের দুই মেয়ে তাহা পারভীন এবং জোহা পারভীন। মহারাষ্ট্রের পুণেয় এক মার্কিন কোম্পানিতে কর্মরত তাহা, আর জোহা অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর। কোহিনুরের দুই মেয়েই পুজো তহবিলে সাধ্যমতো আর্থিক সাহায্য করেন। গত ৩৭ বছর ধরে বাবাকে এত নিষ্ঠার সঙ্গে দুর্গাপুজোর সঙ্গে জড়িত থাকতে দেখে দুই মেয়েই বেশ গর্বিত।
বারিপদার তেঁতুলিডিঙ্গা গ্রামের দুর্গাপুজো উদযাপনের নজরকাড়া দিক হল, বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ। জাত পাত কিংবা ধর্ম সেখানে কোনও বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই প্রতি বছরই প্রতিটি গ্রামবাসী তাঁদের সাধ্যমতো আর্থিক সহায়তা জুগিয়ে চলেছেন। আর তা থেকেই পুজোর পাশাপাশি গ্রামে বসবাসকারী সকল সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে করা হয় ‘ভোগ’ বিতরণও। আশপাশের গ্রামের মানুষও উৎসবে অংশ নিতে পূজা মণ্ডপে ভিড় জমান।
এখানকার দুর্গাপুজো ঘিরে বিস্তৃত সাজসজ্জা, আলো এবং প্রতিমার চেয়েও কোহিনুরের হৃদয়ের ভক্তিকে কুর্নিশ করেছেন পুরোহিত পরিতোষ নন্দ। গত ২১ বছর ধরে তিনি এই পুজোর সঙ্গে জড়িত। পুজো কমিটির সদস্য বিজন দাস, দীপক মিশ্র, ভগীরথী নায়করা বলেছেন, ”বড় ভাই কোহিনুরের জন্যই আমাদের পুজো এত সফলভাবে একটানা চলছে।”
রাজনৈতিক নেতাদের নানান উস্কানি সত্ত্বেও গত চার দশক ধরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়কে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে তেঁতুলিডিঙ্গা গ্রাম।