দিব্যেন্দু ঘোষ
শোভাবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে পাশেই পেট্রোল পাম্প, গমগমে, সোজা কালো পিচঢালা রাস্তাটা বেমক্কা পড়ে থাকে ওদের পায়ের স্পর্শের আশায়, দুদণ্ডও জিরোনোর উপায় নেই। জমজমাট মোড়, গাড়ির ঢেউ, শর্ট ফ্রক, খোলা পা বেয়ে নেমে আসে মখমলি মসৃণতা, নীচে রংদার জুতোয় প্রাণখোলা হাসিমাখা তন্বীদের সর্পিল গতি, গাড়ি যায়, ট্রাফিক পুলিশের মোটা রশির বেড়া, এপারে দাঁড়িয়ে থাকে ওরা, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, কামনামদির, পুলিশ দড়ি ফেললেই এগিয়ে যায়, উত্তাল বাসনার ডিঙিতে চেপে, একটু এগিয়ে বাঁ-হাত পেরিয়ে ভিতরের দিকে কলকাতার গলিময় পাড়া, উপপাড়া পেরিয়ে অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট পেরিয়ে এশিয়ার বৃহত্তম নিষিদ্ধ পল্লি।
না, ওই গলি, তস্য গলিতে আলো ঢোকা নিষেধ নয়, পুজোর কটা দিন বাড়তি লাভের আশায় কমদামি অথচ চকমকে জামা, শাড়িতে সাজতে নিষেধ নেই, ঠোঁটে লিপস্টিকের রঙে বিষাদের ছায়া ঘনিয়ে এলেও ওদের রাস্তায় দাঁড়াতে নিষেধ নেই, বাচ্চাদের দামি ড্রেস কিনে দেওয়ায় নিষেধ নেই, তবে চোখ বেয়ে জল গড়ানোয় দেদার নিষেধ, বেশ্যাপাড়ার মাটি ছাড়া প্রতিমা তৈরির খড়ের বাঁধুনিতে মাটির প্রলেপ পড়ায় নিষেধ, ঠাকুরদালানে ওদের ওঠা নিষেধ, তবে বাচ্চাদের বুকে আগলে হাউহাউ কান্নায় নিষেধ নেই।
পুজোর আলোআঁধারিতে ওদের মনের হদিশ পেতে চাই। ওদের মনভাল, মনখারাপের দলিল-দস্তাবেজ খুলে পড়তে চাই, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উত্সবে ওদের নিষিদ্ধ যাপনের উপন্যাসের পাতা উল্টে দেখতে চাই, ওদের কথা বলতে চাই, পুজোর রঙিন ভিড়ে ওই ফ্যাকাশেয়ানার গল্প বলতে চাই। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ, শোভাবাজারের সঙ্গে বিডন স্ট্রিটের সংযোগে বিকেলের রং বিষণ্ণ হলুদ হয়ে আসছে। আমরা হাঁটছি এক জিজ্ঞাসু পৃথিবীর বুক থেকে নুড়ি-পাথর তুলে নিতে। প্রায় বারো হাজার যৌনকর্মীর বাস এখানে।
ব্রিটিশদের শুরু করা, ব্রিটিশ সৈনিকদের জন্য, যারা সেই সূদুর ইংল্যান্ডে তাদের অর্ধাঙ্গিনীদের রেখে এখানে চলে এসেছিল। ভারতে উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য যে মূল অস্ত্র সৈনিক, তাদের ভারতে রেখে দেওয়ার জন্য টাকা পয়সার সঙ্গে আরও কিছু প্রলোভনেরও তো দরকার। তাই ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতে প্রতিষ্ঠিত হল প্রথম ‘রেড লাইট এরিয়া’, এইভাবে এত বড় করে স্পষ্ট দিবালোকে, যা আগে ছিল সবই গোপন, লুক্কায়িত, রাতের অন্ধকারে মিশে যাওয়ার মতো। তখন দেহোপজীবিনী হয়ে আসত আশপাশের অঞ্চলের বিধবারা। সতীদাহ প্রথা ১৮২৯ সালে রদ হওয়ার পর অবিভক্ত বাংলায় তখন অল্পবয়সী বিধবারা সকলের বোঝা, না ফেলা যায়, না গেলা যায়; এই অবস্থায় বিধবাদের পুড়িয়ে মারা না হলেও তাদের উপর পারিবারিক অত্যাচার চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। বাধ্য হয় কিছু বিধবা বাড়ি ছাড়তে, বা কিছু কিছু বিধবার থেকে তাদের মৃত স্বামীর সমস্ত সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, কাউকে বা সরাসরি এখানে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এই অল্পবয়স্ক বিধবারা, সতীদাহ প্রথা রদের ফলে যারা বেঁচে গেল, তারা কিন্তু আসলে বাঁচল না, তাদের জায়গা হল সোনাগাছি। সেই উনিশ শতকের আলো আঁধারিতে আজও নিষিদ্ধতার ছায়া পড়ে, তির্যক, সোনারোদ ঢেকে দিতে ওদের মনখারাপই যথেষ্ট।
কদমগাছটায় পাতা এসেছে, সবুজ সে পাতায় বেঁচেবর্তে থাকার ধুলোর পুরু আস্তরণ, কদম ফুল ফোটে, ওদের সেদিকে তাকাতে মানা, কদমডালে কৃষ্ণ হয়ত বাঁশি বাজায়, কিন্তু সে সুর শুনতে ওদের নিষেধ। প্রেম নয়, ওদের শরীরে বয়ে আসে যৌনতা, অর্থের বিনিময়ে, রোজগার, বাচ্চাগুলোর মুখে দুবেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার অঙ্গীকার।
অভিমানের দেওয়াল থেকে পলেস্তারা খসে পড়ছে, কষ্টের জ্বালা মাটি ভিজিয়ে দেয় অবিরত, স্যাঁতসেতে দমকা হাহাকার মণ্ডপের মাইকের জমাট কণ্ঠস্বর ভেদ করে আসে না, আসতে দেওয়া হয় না, ওরা প্রকৃতই থাকে ওধারে। নারী যখন শক্তি হিসাবে পূজিত হয়, ওরা তখন ঠোঁটে রং মেখে, স্বল্পবাস পরে রাস্তাতে দাঁড়ায়, পরিবারটাকে বাঁচিয়ে রাখতে, পুজোয় অন্তত একটা নতুন জামা ছেলেটাকে বা মেয়েটাকে কিনে দিতে। যারা দিনের আলোয় ফিটফাট ভদ্রলোক, যৌনতার কথা প্রকাশ্যে শুনলে নাক কান মুলে চোখ বন্ধ করে ‘রাম রাম’ জপে নেন, তারাই এই ব্যবসাটাকে রাতের অন্ধকারে বাঁচিয়ে রাখেন। যাদের ছায়া সকালের আলোয় মাড়ালেও এনারা গঙ্গাস্নান করেন, রাতের অন্ধকারে পয়সার বিনিময়ে এনারাই তাদের ভোগও করেন। কেউ উপপত্নী রাখেন, কেউ রক্ষিতা রাখেন, এই মেয়েগুলো তখন হয়ে ওঠে তাঁদের ‘বাঁধা মেয়েমানুষ’। আর তাদের গর্ভে সন্তান এলে? হয় তারা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নষ্ট হয়ে যায়, অথবা পরিচয়হীনতার অন্ধকারে যৌনকর্মীর সন্তানরূপে সমাজের অবহেলিত কোণায় ‘একঘরে’ হয়ে পড়ে থাকে, কারণ ততদিনে সেই ‘বাবু’টি যে কোথায় নিরূদ্দেশ হয়েছে! ‘বাঁধা মেয়েমানুষে’রও তো বয়স বাড়ে, যৌবন হারায়! কিন্তু সন্তানের মুখ চেয়ে ওদের কাজ করতে হয়, শরীর বিক্রি করতে হয়, যন্ত্রণার লাভাকুসুম শরীরে ছটফটিয়ে উঠলেও ওরা সহ্য করে, ছেলেটা বা মেয়েটাকে একটা জামা যে কিনে দিতে হবে এই পুজোয়।
এই ‘বেশ্যালয়ে’র মাটি ছাড়া আমাদের শক্তির আরাধনা, দুর্গাপূজাও তো সম্পূর্ণ হয় না, তবুও, এই পঙ্কিল গা গুলিয়ে ওঠা পরিবেশ বদলায় না, পুজোর খুশি উপচে এসে পড়ে না ঘুপচি ঘরগুলোয়, বাচ্চাগুলোকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর চেষ্টা চলে, কখনও হয়, কখনও হয় না। পুজো আসে, চলে যায়, কিন্তু এই ‘রেডলাইট এরিয়া’র মেয়েদের সবচেয়ে বড় অভিশাপ মোছে না। সেই সোনাগাছির একটি বেশ্যাবাড়ির, একতলার কোণের দিকে ঝুপড়ি একটা ঘর, যে ঘরে বহুদিন কোনও ‘বাবু’র পা পড়ে না। সেই ঘরে রোগশয্যায় শায়িত এক বেশ্যা স্ত্রীলোক, পিতৃদত্ত নাম কোথায় হারিয়ে গেছে তার খবর কেউ রাখে না, সবাই ওকে রাজিয়া বলেই জানে। একসময়ে তার জায়গা ছিল এই বাড়ির ওপরমহলে। তখন রূপ ছিল, যৌবন ছিল, চমক-ঠমক ছিল, অনেকের ঈর্ষাও ছিল রাজিয়ার উপর, রাতে তার ঘর কখনও ফাঁকা থাকত না। সেই রাজিয়া চুপটি করে শোনে পুজো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসছে স্তোত্রপাঠ, রোগশয্যায় শায়িত রাজিয়ার ‘শরীল কি খুব খারাপ লাগচে? এ যে খুব জ্বর, গা যে পুড়ে যাচ্চে!’ ছোট্ট ছেলেমেয়ে দুটো নতুন জামা পরেছে, মণ্ডপের দূরে দাঁড়িয়ে ঠাকুর দেখবে বলে, কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রমাণ করবে বলে, মাকে ভাল করে দেওয়ার প্রার্থনা করবে বলে, আসলে মণ্ডপের কাছাকাছি যে ওদের যাওয়ায় নিষেধ, ‘যা এখান থেকে’ বলে কেউ হয়ত ভাগিয়ে দেবে, কিন্তু ওদের যে যেতেই হবে, মাকে ভাল করে দেওয়ার প্রার্থনা ঠাকুরের কাছে করতে হবে যে। অন্ধকার ঘরটার চৌকাঠে পড়ে আছে হতাশার আঁধার, রংচটা দেওয়ালে লেপ্টে আছে অভিমানের কান্না, খসে পড়া সিলিং থেকে ঝুলছে নিঃসঙ্গতার ভারী বাষ্প।
কে যেন বলে ওঠে ‘অ দিদি! তোমার পয়সা কোথায় রাকো? দ্যাও না, ডাগতাররে খপর দিই!’ রাজিয়া কিছু বলে না, বলতে পারে না, চোখ দুটো ছলছল করছে, মায়ের পাশে বসে আছে ছেলেমেয়ে দুটো। রাজিয়া কেমন করে যেন পুরনো দিনে ফিরে গেছে, সেই গ্রামের বাড়ি, বাবা, দাদা, মা ছিল না, দাদার বিয়ে হল, সানাই বাজল, লোক খেল, বৌদি এল। তারপর বাবা হঠাৎ একদিন মরে গেল। তারপর দাদা একদিন শহরে মেলা দেখাতে নিয়ে আসার নাম করে তাকে এখানে বিক্রি করে দিল, আচ্ছা, সে কি অনেক খেত? তবে যে বাবা বলত, বাবা কি যেন বলত! ‘ও বাবা! কী যেন বলতে তুমি!’, হ্যাঁ, বাবা বলত, ‘খুকি, এত কম খেলে গায়ে জোর পাবি কী করে!’, তবে তো সে কমই খেত! দাদা, নিজের মায়ের পেটের দাদা, রক্তের টান, কেমন করে বিক্রি করে দিল তাকে! আচ্ছা, একটা যেমন তেমন বরও কি তার জুটত না! এখানে যখন সে এসেছিল, কত বয়স তার? বড়জোর পনেরো! জানতই না, এ জায়গাটা কী, কী হয় এখানে! একটা লোক, তার মুখটা মনে নেই, সে এসে মাসির কাছে দিয়ে গেছিল তাকে! সেই মাসিই তাকে চান করাল, গ্রামের পোশাক খুলিয়ে দিল, তাকে কীরকম সব অদ্ভুত ছোটখাটো পোশাক পরিয়ে দিল, কীরকম উগ্র সাজিয়ে দিল, এভাবে সে কোনওদিন সাজেনি আগে! আঁট করে চুল বাঁধা, চোখে মোটা কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক! তার পনেরোর জীবনে তখন কৈশোর, বৃদ্ধির সময়। একটা ঘরে একা বসে, সেই রাতে মানুষের চরম বীভৎস রূপ সে দেখেছিল, একরাতে বড় হয়ে গেছিল সে। মানুষ এত ভয়ঙ্কর হয়, এত কদর্য! তার বাবার চাইতেও বড় একটা লোক, মুখটা আজও তার মনে আছে, উফ! কী লেগেছিল তার! খুব খুব লেগেছিল! সে যন্ত্রণায় চিৎকার করছিল, লোকটা হাসছিল! বিছানাটা ধীরে ধীরে লাল হয়ে গেছিল।
কুড়ি বছর পর, তার আজ কেন এসব কথা মনে পড়ছে? আসলে সে দিনটাও পুজোর ষষ্ঠী ছিল, আজও তাই। হাত বাড়িয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে কাছে টানল রাজিয়া। রাজিয়ার মনে পড়ছে, টাকা তার হয়েছিল, বেশ ভালই হয়েছিল, কত বাবু কত রাতে খুশি হয়ে পাওনার উপর উপরি কিছু বকশিশ দিয়ে গেছে! সবাই হিংসে করত, রাজিয়া মাগীর ঘর কখনও ফাঁকা থাকে না! কেউ কি দেখত, প্রতি ভোরে তার শরীরের কালশিটের দাগগুলো? শরীরের ভিতরটা ব্যথায় আড়ষ্ট হয়ে যেত, হাঁটতে কষ্ট হত; সেই অবস্থায় আবার, আবারও তাকে শুতে হত। টাকার বিনিময়ে মানুষ যে ‘জন্তু’ হয়ে যেতে পারে, এটা তাদের চেয়ে ভাল আর কে জানে? ছেলেমেয়ের হাত দুটো ধরে অঝোরে কাঁদছে রাজিয়া। কত পুজো যে কেটে গেছে এভাবে। বিষণ্ণতার মেঘ করে এসেছে, মনখারাপের বৃষ্টি নেমেছে, বুকের ভেতর সে জল কোনওদিন শুকোয়নি। মনে পড়ছে মায়ের কথা, গ্রামের কথা, পুজোর কথা, মাঠের ওপাশে কাশফুলের মাথা দোলানোর কথা। নতুন সস্তার ফ্রক পরে গ্রামের মণ্ডপে যাওয়ার কথা, মাথায় দুহাত ঠেকিয়ে প্রণাম করার কথা। মায়ের কাছে কী চেয়েছিল রাজিয়া?
আজ আর কিছু মনে নেই তার। দূরে প্যান্ডেলে গান বাজছে,
এই রাত তোমার আমার
ওই চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের
এই রাত শুধু যে গানের
এই ক্ষণ এ দুটি প্রাণের
কুহু কুজনের
এই রাত তোমার আমার।