স্নিগ্ধা চৌধুরী
সপ্তমীর প্রভাতে বাঙালির হৃদয়ে বিরাজমান হয় মহাদেবীর অমোঘ শক্তি। আজ পূজিতা দেবী হলেন মা মহাগৌরী, যিনি শান্তি, পবিত্রতা এবং মোক্ষের প্রতীক। মহাগৌরীর সুদূর প্রাচীন কাহিনী পুরাণে বর্ণিত পাহাড়-জঙ্গলে কঠোর তপস্যার জ্বালায় অনশন ও প্রার্থনার মধ্য দিয়ে তিনি মহাদেবের অনুগ্রহ প্রাপ্ত করেন। তপস্যার ফলে কৃষ্ণবর্ণাকৃতি হয়ে ওঠেন তিনি। পরবর্তীতে গঙ্গাজলে স্নান করলে দুধের মতো শুভ্ররূপ ধারণ করেন, আর সেই শুভ্রতাতেই নিহিত তার নাম মহাগৌরী।
মহাগৌরীর চার হাতে নিহিত প্রতীক হলো জীবনের সমস্ত কষ্ট দূর করার মহাশক্তি। ডানহাতে ত্রিশূল ও অভয়মুদ্রা, বামহাতে ডমরু ও বরমুদ্রা। প্রতিটি পদক্ষেপে তিনি শুভশক্তি ছড়িয়ে দেন। নন্দী বৃষের উপর আরোহিত হয়ে দেবী ভক্তদের হৃদয়জগতে আশীর্বাদ রচনা করেন। শ্বেতবস্ত্রে সজ্জিত, চাঁদের আলো সমান উজ্জ্বল গহ্বরহীন দীপ্তিতে ভাস্বর মহাগৌরী প্রতিটি চোখে মায়াময় দৃষ্টি বিন্যস্ত করেন।
পুরাণে বর্ণিত, মহাগৌরীর তপস্যা ছিল নিখুঁত। পাহাড়, জঙ্গল, নদী-উপকূলে দীর্ঘকাল অনশন, ধ্যান ও কঠোর সাধনার মাধ্যমে তিনি মহাদেবের অনুগ্রহ অর্জন করেন। কৃষ্ণবর্ণ থেকে শুভ্ররূপে রূপান্তরিত হওয়ার পর, তিনি বিশ্বজগতের অন্ধকার দূর করে দেবীর রূপে আবির্ভূত হন। আজকের দিনে ভক্তরা শ্বেত অপরাজিতা, চাঁপা ফুল, সাদা মিষ্টি, দুধ ও নারকেল অর্পণ করে দেবীর করুণার প্রার্থনা করেন।
কলকাতার প্যান্ডেল প্রাঙ্গণ আজ আলোকিত শঙ্খধ্বনি, ঘণ্টা ও কাঁসরের মেলবন্ধনে ভক্তরা দেবীর মহিমা স্মরণ করছেন। নবপত্রিকা স্নান, মহাস্নান ও কল্পারম্ভ আজ পূজার অন্যতম আচার। সন্ধ্যায় ধূপকাঠির ধোঁয়ায় পূজা প্রাঙ্গণ শুদ্ধ হয়। দেবী মহাগৌরীর প্রভায় প্রতিটি ঘর আলোয় ভরে ওঠে, প্রতিটি হৃদয় পবিত্র শক্তিতে মোহিত হয়।
উত্তর ভারতের হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, বারাণসী ও গয়া অঞ্চলেও আজ মহাগৌরীর আরাধনা বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। প্রতিটি পূজায় ভক্তরা দেবীর আশীর্বাদে জীবনের অন্ধকার ও দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের আশায় পূর্ণ হন। দুধসদৃশ শুভ্র গাত্রবর্ণ, সাদা বস্ত্র ও মালা, চন্দন দ্বারা অলিপ্ত দেহ, চার শ্বেতবর্ণ বাহু দ্বারা দেবী সর্বত্র শুভশক্তি বিস্তার করেন। আজকের দিনে ভক্তরা দেবীর দীপ্তিতে নিজেদের মন ও জীবনে শান্তি ও মুক্তির আলো অনুভব করেন।
সপ্তমী আজ শুধু উৎসব নয়, এটি হল মহাদেবীর তপস্যা ও পার্বতীর অমোঘ শক্তির মহোৎসব। মহাগৌরীর শুভ্র জ্যোতি যেন মানুষের অন্তরজগৎ আলোকিত করে, জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ধৈর্যের দীপ জ্বালিয়ে দেয়।
