স্নিগ্ধা চৌধুরী
রাতের আকাশে চাঁদ তখন পূর্ণতার দিকে এগোচ্ছে, চারিদিকে ঢাকের আওয়াজে কেঁপে উঠছে শহর-গ্রাম, আর মন্দির থেকে মন্দিরে ছড়িয়ে পড়ছে ধূপ-ধুনোর গন্ধ। এমন এক ক্ষণ যখন সময় যেন থমকে দাঁড়ায়, আলো আর অন্ধকার মিলেমিশে তৈরি করে এক অলৌকিক আবহ। সেই সন্ধিক্ষণেই মহাষ্টমী বিদায় নেয়, মহানবমীর আগমন ঘটে। আর এই অদ্ভুত সময়েই আবির্ভূত হন মা দুর্গা চামুণ্ডারূপে। পূজার্চনার ভেতর দিয়ে যেন শোনা যায় সেই যুদ্ধের গর্জন, যখন অসুর সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডকে ধ্বংস করেছিলেন দেবী।
সন্ধিপূজা পূজা স্থায়ী হয় দুই দণ্ডকাল অর্থাৎ অষ্টচল্লিশ মিনিট। মহাষ্টমীর শেষ চব্বিশ মিনিট ও মহানবমীর প্রথম চব্বিশ মিনিট মিলেই গড়ে ওঠে সেই বিরল সন্ধিক্ষণ। ভক্তরা নিবেদন করেন ১০৮ পদ্মফুল, প্রজ্বলন করেন ১০৮ প্রদীপ। প্রতিটি পদ্ম দেবীর শক্তির প্রতীক, প্রতিটি প্রদীপ ভক্তির জ্যোতি। সঙ্গে থাকে গোটা ফল, লাল জবা, শাড়ি, সাদা চাল আর বেলপাতা সবই নিবেদিত হয় মায়ের চরণে।
কথিত আছে, এই সন্ধিক্ষণে উপবাসী ভক্ত যদি নিষ্ঠাভরে পূজায় অংশ নেন, তবে তাঁর জীবনে যমদণ্ডের ছায়া পর্যন্ত পড়তে পারে না। মৃত্যুকালেও মা দুর্গার কৃপা তাঁকে রক্ষা করে। এমনকি বিশ্বাস আছে, এই এক সন্ধিপুজোর ফলেই ভক্ত লাভ করেন পূর্ণ দুর্গোৎসব পালনের সমান শুভফল।
পুরাণে এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু কাহিনি। মহিষাসুরবধের সময়ে দেবীর কপালের তৃতীয় নেত্র থেকে উদ্ভূত হয়েছিলেন কালিকা, আর সেই সময়েই দেবী চণ্ড ও মুণ্ডকে বধ করেন। তাই সন্ধিপুজো স্মরণ করায় দেবীর চামুণ্ডারূপে আবির্ভাবকে। অন্যদিকে, রাক্ষসরাজ রাবণকে বধের আগে রামচন্দ্রও করেছিলেন এই সন্ধিপুজো। দেবীর পদপ্রান্তে নিবেদনের জন্য তিনি চেয়েছিলেন ১০৮ পদ্ম, কিন্তু পাওয়া গিয়েছিল মাত্র ১০৭টি। সেই অভাব পূরণ করতে তিনি প্রস্তুত হয়েছিলেন নিজের চোখ উপড়ে অর্পণ করতে।
এই ঘটনার আদি সূত্র ছিল আরও এক করুণ কাহিনি। অসুর নিধনের যজ্ঞে দেবীর শরীরে সৃষ্টি হয়েছিল একশো আটটি ক্ষত। যন্ত্রণায় কাতর মাকে মহাদেব দেবীদহে স্নান করতে বলেন। ক্ষত থেকে জন্ম নেয় একশো সাতটি পদ্ম, আর মহাদেবের চোখের অশ্রু থেকে জন্ম নেয় একশো আটতম পদ্ম। কিন্তু স্বামীর অশ্রুসিক্ত ফুল দেবী নিজেই তুলে নেন, ভক্ত নিবেদন করেননি। তাই দেবীদহে থেকে গিয়েছিল মাত্র ১০৭টি পদ্ম, যা রামচন্দ্রকে চোখ অর্পণের সংকল্পে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
এভাবেই কাহিনি আর আচার মিলে সন্ধিপুজোকে করে তোলে এক অনন্য মুহূর্ত। মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিক্ষণে তাই ভক্তরা উপলব্ধি করেন এ শুধু পূজা নয়, এটি ভক্তি ও শক্তির মহামিলন। প্রদীপের শিখায়, পদ্মের সুবাসে আজও ধ্বনিত হয় সেই বাণী অশুভ যত প্রবল হোক না কেন, দেবী চামুণ্ডার আবির্ভাবে ন্যায়ের জয় অবশ্যম্ভাবী।