স্নিগ্ধা চৌধুরী
শারদীয় উৎসবের নবম প্রভাত ভোরের আকাশে ছড়িয়ে দেয় এক অন্য আলো। এই দিনেই দেবী দুর্গা সিদ্ধিদাত্রী রূপে আবির্ভূতা হন ভক্ত হৃদয়ে। পুরাণ বলে, এই মহাশক্তিই শিবকে দান করেছিলেন অষ্টসিদ্ধি অনিমা, মহিমা, লঘিমা, প্রাপ্তি, প্রাকাম্য, ঈশিত্ব, বসিত্ব ও কামাবসায়িতা। সেই থেকে নবমী পূজা শুধু শক্তি আরাধনার নয়, ভক্তের জীবনে সর্বসিদ্ধির দ্বার উন্মোচনের দিন। সংসারের অন্ধকার, দাম্পত্য কলহ, দুঃখ ও অভাব দূর করতে সিদ্ধিদাত্রী দেবীর আশ্রয়ই ভরসা।
নবমীর সকাল থেকেই মণ্ডপে ভিড় বাড়ে, ঢাকের তালে তালে অনুরণিত হয় দেবীর স্তোত্র। ভক্তরা জানেন, আজকের দিন প্রতিটি উপচার, প্রতিটি নিবেদন মায়ের আশীর্বাদ টেনে আনে জীবনে। মহাশাস্ত্রে বলা আছে, সিদ্ধিদাত্রী দেবীর আরাধনায় জীবনের গহ্বর ভরে ওঠে শান্তিতে, সংসারের বিবাদ মুছে যায়, দাম্পত্য বন্ধন আরও দৃঢ় হয়। তাই ভোর থেকে রাত্রি অবধি চলে নানা পূজা, অর্ঘ্য, নিয়মাচার।
এই দিনে দেবীকে নিবেদন করা হয় প্রসূন ও উপহার। আটটি পদ্মফুল, অপরাজিতা, আর অগণিত বেলপত্র সবই যেন একেকটি মন্ত্রের মতো ভক্তির গভীরতা ঘোষণা করে। অনেকেই দেবীর পায়ে লাল ওড়না, মাখানা, বাতাসা আর রৌপ্যমুদ্রা অর্পণ করেন। বিশ্বাস, এই নিবেদনে দেবী তুষ্ট হন, সংসারের দুঃখ-দুর্দশা মিলিয়ে যায়। সন্ধ্যায় বাড়ির অগ্নিকোণে জ্বলে ওঠে প্রদীপ, আরতি গাইতে গাইতে ভক্ত মনে হয় যেন দেবী স্বয়ং আলোকবিন্দুর মতো নেমে এসেছেন সংসারের অন্তরালে।
শাস্ত্রে আছে, অর্থকষ্টে জর্জরিত ভক্ত যদি আজকের দিনে দেবীকে গঙ্গাজলে স্নান করান, দুর্গারক্ষাকবচ পাঠ করেন, কর্পূরের আরতি করেন, তবে তার সংসারে লক্ষ্মীর স্থায়ী অধিষ্ঠান ঘটে। আবার দেবীর নাম উচ্চারণে যে সুর বেজে ওঠে, তা কেবল মন্ত্র নয়, বরং আশীর্বাদের সোপান। নবমীর রাতে দুর্গাস্তোত্র পাঠ মানসিক অশান্তি মুছে দেয় বলে বিশ্বাস।
এই মহাশুভ দিনে পোশাকেরও আছে মাহাত্ম্য। নবমীতে কালো পরিধান বর্জন করা হয়। ভক্তরা বলেন, সেই রঙ অশুভ শক্তির প্রতীক। পরিবর্তে বেগুনি রঙের পোশাক পরলে গৃহস্থলীর দ্বন্দ্ব প্রশমিত হয়। এমনকি খাদ্যাভ্যাসেও আছে বিধান আজকের দিনে লাউ ভক্ষণ এড়িয়ে চললে দাম্পত্য জীবনে আসবে অটল শান্তি।
প্রাচীন কালে নবমীতে অনুষ্ঠিত হত হোমযজ্ঞ। আজও বহু জায়গায় সেই প্রথা পালিত হয়। যজ্ঞশেষে অগ্নি থেকে প্রাপ্ত পবিত্র ছাই বাড়িতে নিয়ে এসে সংরক্ষণ করলে বাস্তুদোষ নাশ হয়, সংসার ভরে ওঠে সুমঙ্গল আলোয়। আরেকটি প্রথা বলে, গোলাপের পাঁচ পাপড়ির দুই পাশে মধু মেখে দেবীর কাছে নিবেদন করলে জীবনে প্রবাহিত হয় সৌভাগ্য।
কিন্তু নবমীর সবচেয়ে মহিমাময় আচার হল কুমারী পূজা। নয় কুমারীকে আহ্বান করে ভোজন করানো হয় দেবী স্বরূপ ভেবে। বিশ্বাস, প্রতিটি কুমারীই হলেন মহামায়ার জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। তাঁদের আহার, তাঁদের সম্মান সেই সবই আসলে দেবীর পূজা। যে পরিবার এই ভোজের আয়োজন করে, তাদের গৃহদ্বারে দেবীর চরণচিহ্ন অমোঘভাবে স্থায়ী হয় বলে লোককথা শোনায়।
আজকের দিনে কেবল আচার নয়, এক অতল রহস্যও বিরাজমান। দেবী সিদ্ধিদাত্রী যেন ভক্তকে বোঝান শক্তি কেবল যুদ্ধের অস্ত্র নয়, শক্তি হল ধৈর্য, প্রেম, মমতা। সংসারের অশান্তিকে তিনি শান্তিতে রূপান্তরিত করেন, অভাবকে সমৃদ্ধিতে পরিণত করেন। শাস্ত্র যেমন বলেছে, “যত্র নার্যঃ পূজ্যন্তে, তত্র রমন্তে দেবতাঃ” যেখানে নারীকে সম্মান করা হয়, সেখানেই দেবতাদের বাস। নবমীর দিনে সেই শ্লোক যেন আরও সত্য হয়ে ওঠে।
মহানবমীর সন্ধ্যায় ঢাক বাজে, ধূপে ধোঁয়ায় ভরে ওঠে মণ্ডপ, ভক্তরা অঞ্জলি দেন চোখের জলে। প্রত্যেকের মনে একটিই বিশ্বাস, সিদ্ধিদাত্রীর আশীর্বাদে সংসারের সব অন্তরায় দূর হবে, প্রেম আর শান্তির আলোয় ভরে উঠবে জীবন।