
দিব্যেন্দু ঘোষ
প্রিয় টুপুর,
শুভ বিজয়ার আদর নিস। তোকে ছাড়া কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। কেন এত দূরে চলে গেলি বল তো! তোর মতো মেয়ের এ দেশে চাকরির অভাব! কলকাতায়, অ্যাট লিস্ট ভুবনেশ্বরের চাকরিটা নিলেও তোর সঙ্গে দেখা হত। তুই আসতে না পারলেও আমি চলে যেতাম তোর কাছে। কিন্তু তুই সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে চাকরি করতে চলে গেলি। পুজোয় তোকে ছাড়া আমার কোনওদিন ভাল্লেগেছে বল? পুজোর আগে হাত ধরাধরি করে কুমোরটুলি, গলি থেকে আরেক গলি, মাটির সেই সোঁদা গন্ধ, আমার ডিএসএলআরে তোর আদুরে ফটোর কোলাজ, তোকে বারণ করলেও তুই সেই শাড়ি পরবিই আর পায়ে জড়িয়ে একবার না একবার পড়বিই, সেই বড় আটচালার প্রতিমার আড়ালে তোর ঠোঁটে প্রথম চুমু, টুপুর মনটা বড্ড খারাপ রে। এই মনোরম আশ্বিন, কেমন করে যে কাটালাম। তুই এত নিষ্ঠুর কেন বল তো, এভাবে কেউ তার প্রিয় মানুষকে ছেড়ে চলে যায়! নাকি তোর আর আমাকে ভাল্লাগে না?

তোর বাড়িতে এসেছি। কাকিমা, কাকু, তোর দাদু, ঠাকুমাকে প্রমাণ করলাম। কাকিমা নিজের হাতে বানানো প্যাঁচানো নিমকি, কুঁচো গজা, নারকেল নাড়ু, ঘুগনি কত যত্ন করে খাওয়াল। তুই তো পেলি না। ভাল হয়েছে, যেমন আমাদের ছেড়ে দূরে চলে যাওয়া। কাকুদের সঙ্গে বসে তোর নামে কত যে পিএনপিসি করলাম। কাকিমা জিজ্ঞেস করছিল, পুজো কেমন কাটল। তুই বল, তোকে ছাড়া আমার পুজো কেমন কাটতে পারে। কেন আমি তোদের বাড়ির পুজোয় যাইনি, কাকু জিজ্ঞেস করেনি। ওরাও বুঝতে পারছে আমার মন খারাপের কথা, শুধু তুইই বুঝলি না। তোদের ঠাকুরদালানে বসে একসঙ্গে মহালয়া শোনা, সামনে মায়ের গায়ে খাপছাড়া রং, পুজোর কোন দিন তুই কী পরবি, আমি কী পরব, সব কেমন দুজনে মিলে ঠিক করতাম। তুই ওখানে কী কী পরলি, হোয়াসঅ্যাপে একটাও ছবি আসেনি, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামেও কোনও পোস্ট করিসনি। পুজোর একটা দিনেও ভিডিয়ো কল করিসনি। তুই বলবি, আমি করিনি কেন? বেশ করেছি, করিনি। অভিমান আমারও হয়, ওটাতে শুধু তোর একার অধিকার না। ষষ্ঠীর সকাল থেকেই তোদের ঠাকুরদালানে আমাদের একচ্ছত্র অধিকার, কলাবউ স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধি পুজো, বিসর্জনে ঢাকের তালে নাচ, সিদ্ধি খেয়ে আমার গায়ে তোর গড়িয়ে পড়া, ঠাকুর জলে পড়লে যৌথ মন খারাপ, গঙ্গার ঘাটেই আমায় জড়িয়ে ধরে তোর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না। টুপুর কেন আমায় এভাবে শরতে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেলি বল তো?

নামী সফটঅয়্যার কোম্পানির সিনিয়র ডেভেলপার টুপুর মুখার্জির এখন আর এসবে মন নেই। কেজো জগতে মন খারাপ নেই, আবেগ নেই, প্রেম নেই, ভালবাসা নেই, অভিমান নেই, অভিমান ভাঙানোর চুমু নেই। বিজয়ার দিন সন্ধেবেলায় সেই লালরঙের খেরোর খাতায়, লাল কালির পেন দিয়ে ‘শ্রীশ্রীদুর্গাসহায়’ কথাটা মোট বারো বার করে লিখতাম দুজনে। তার পর বাড়ির গুরুজনদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম। একটু ফাঁকা সময় পেলেই বিজয়ার চিঠি লিখে রাখতাম আমরা, বল। পুজোর ঠিক আগে পোস্টাপিস থেকে গোছা করে হলদেটে পোস্টকার্ড বা ফিকে নীলরঙা ইনল্যান্ড লেটার কিনে আনতাম। একাদশীর দিন সাতসকালে, হয় পোস্টাপিসে গিয়ে আর তা নইলে পাড়ার গোমড়ামুখো লালরঙা ডাকবাক্সে চিঠিগুলো ফেলতাম। মনে আছে তোর, বড়মাসিমাকে লেখা মায়ের বিজয়ার চিঠির তলার দিকের কিছুটা জায়গায়, আমাকেও একটি প্রণামী-চিঠি লিখতে হত। পরীক্ষার খাতায় ‘পত্র লিখ’-র বাইরে সেটাই আমার প্রথম সত্যিকারের চিঠি লেখা। তুই বলতিস, ছেলেবেলায় বাঙালি নাবালকদের বিজয়ার চিঠি লেখার এই যে অভ্যেস, সেটাই পরের দিকে অগুনতি বাঙালি কিশোর-কিশোরী এবং যুবক-যুবতীকে নিরলসভাবে প্রেমের চিঠি লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিজয়ার চিঠি, সে তো মেরেকেটে পাঁচ-সাতটা। কিন্তু প্রমের চিঠি সেখানে হেসেখেলে হাফ সেঞ্চুরি পার করে দিত। তোকেই তো কত্তগুলো দিয়েছি, বল? জানিস টুপুর, লরির ওপর মা দুগ্গার মিষ্টি-গোঁজা মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেছি, আসছে বছর আবার এসো মা! সামনের বছর টুপুর যেন দেশে ফিরে আসে অনেক বড় প্রমোশন নিয়ে। বল, ঠিক বলেছি তো! চিঠি দিস। আদর নিস।
ইতি,
তোর টুবাই দা
