
শারদীয় দুর্গোৎসবের প্রার্থনা যখন শেষ হয়, আকাশে ছড়িয়ে পড়ে পূর্ণিমার চাঁদের কোমল আলো, তখন শুরু হয় এক রহস্যময় রাত্রি কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। এই রাত যেন দেবী লক্ষ্মীর পদচারণার অপেক্ষায় ঘরে ঘরে জেগে থাকা মানুষের হৃদয়কে আহ্বান জানায়। “কো জাগরী” অর্থাত্ কে জেগে আছো এই প্রশ্ন দিয়ে শুরু হয় পূজা, এবং বিশ্বাস, যে ঘরে কেউ জেগে থাকে, সেই ঘরে মা লক্ষ্মী প্রবেশ করে সমৃদ্ধির ঝাঁপি ঢেলে দেন।

পৌরাণিক বর্ণনায় লক্ষ্মী দেবী চঞ্চলা, কিন্তু ক্রোধী নন। তিনি শুধু ভালবাসা, সৌভাগ্য ও ধন-সম্পদের দাতা। তাই বাঙালি গৃহস্থরা সতর্কভাবে পিঁড়ি সাজিয়ে দেবীকে আমন্ত্রণ জানায়। পূজার পাত্রে রাখা হয় ধান, কলা, মিষ্টি, মোয়া, হলুদ ও স্বর্ণমুদ্রা। কলাপাতা, কড়ি ও পান দিয়ে সাজানো হয় স্থান। আলপনায় ফুটিয়ে তোলা হয় দেবীর পায়ের ছাপ প্রতীক, যেন মা ঘরে প্রবেশ করবেন।পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী, কোজাগরী পূর্ণিমার রাতটি দেবীর পর্যবেক্ষণের রাত। তিনি ঘরে ঘরে দেখেন, কে জেগে আছে। যে জেগে থাকে, সেই ব্যক্তি পায় জীবনে ধন-সম্পদের পরিপূর্ণতা। যার নেই, তাকে দেবী আশীর্বাদ দিয়ে দেন প্রাচুর্যের দান। এই রাতে জেগে থাকা মানে শুধুই শারীরিক নয়, বরং মানসিক জাগরণ আধ্যাত্মিক জাগরণ।

ঐতিহাসিকভাবে কোজাগরী পূজার সময় খরিফ ও রবি শস্যের মেলবন্ধন ঘটে। কৃষিজ আচার ও দেবীপূজার এই মিলনে দেখা যায় প্রকৃতি ও মানব জীবনের অন্তরঙ্গ সংযোগ। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, মূলত ভাল ফলনের কামনা করাই এই পূজার উদ্দেশ্য, কিন্তু আধ্যাত্মিক দিক থেকেও এটি মানুষের জীবনকে আলোকিত করে।পূজার সময় মোট ১৪টি পাত্রে রাখা হয় উপাচার। পূর্বপুরুষদের উদ্দেশে জল দানের রীতি পালিত হয়, যেন অতীতের ছায়া ও ভবিষ্যতের আশীর্বাদ মিলিত হয়। এই রাতে ঘরের কোণে ছোট আকারের পিঁড়ি বা মাটির প্রতিমায় দেবীকে স্থাপন করে পূজা সম্পন্ন হয়। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশে পূজার ধরন আলাদা হলেও মূল বিশ্বাস অটুট, যে ঘরে দেবী প্রবেশ করেন, সেই ঘরে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সৌভাগ্য বর্ষিত হয়।

কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা শুধু ঘরে ঘরে সম্পদের কামনা নয়, এটি আধ্যাত্মিক জাগরণের, দেবীর পদচারণার এবং মানুষের হৃদয়ের আলো ফোটানোর অনুষ্ঠান। পূর্ণিমার জ্যোতি, জেগে থাকা মানুষের প্রার্থনা, পাত্রের ধন-সম্পদ সব মিলিয়ে সৃষ্টি করে এক দেবী-রজনী, যেখানে প্রতিটি ক্ষণ যেন আকাশে লুকিয়ে থাকা দেবীর দৃষ্টি।

এই রাতে ঘরে থাকা মানে শুধু ধন অর্জন নয়, বরং আত্মার জাগরণ, মন ও হৃদের সমৃদ্ধি। কোজাগরী লক্ষ্মীর আলো ঘরে ঘরে প্রবেশ করে জীবনের আঁধার দূর করে, শান্তি, সৌভাগ্য ও জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেয়। এই পূজা এককথায় মানব ও দেবীর অন্তরঙ্গ মিলনের রাত, যেখানে ঘুম নয়, জাগরণ এবং সেই জাগরণই আনে দেবীর আশীর্বাদ।