
রাজা বন্দ্যোপাধ্যায়
দশকের পর দশক ধরে বিজয়া দশমীর দিন আরএসএস প্রধানের ভাষণ সংগঠনটির ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবারের বক্তৃতায় মোহন ভাগবতের ব্যবহৃত শব্দ, উপমা ও ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছে যে, সংগঠনের ভিতরে নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অস্বস্তি এবং অসন্তোষ জমে উঠছে।
ভাগবত তাঁর বক্তৃতায় বলেন, “বিশ্বকে একটি ‘নতুন মডেল’ দিতে হবে ভারতকে।” এই মন্তব্যকেই অনেকে মোদির তথাকথিত “গুজরাত মডেল” বা “মোদি মডেল”-এর প্রতি অসন্তোষ হিসেবে ব্যাখ্যা করছেন। তিনি স্পষ্ট করে জানান, বর্তমান উন্নয়নধারা থেকে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে এক নতুন পথে এগোনো দরকার। ভাগবত তাঁর ভাষণে যে বিষয়গুলোকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন :
•ধনী-দরিদ্রের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ফারাক
•ক্ষমতাশালীদের দ্বারা সাধারণ মানুষের শোষণ
•হিমালয় অঞ্চলে নির্বিচারে উন্নয়ন প্রকল্পে পরিবেশের ক্ষতি
•মহাত্মা গান্ধীর সরলতা ও সংযম থেকে শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা

আর এসব বিষয়ই কেন্দ্রীয় সরকারের তথাকথিত “উন্নয়ন”-এর দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। ভাগবত বর্তমান সমাজে সহিংসতা ও গুন্ডামির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন এবং সামাজিক ঐক্যের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। তাঁর ভাষণের এই অংশেই মোদি সরকারের রাজনৈতিক ভাষার সঙ্গে ভাগবতের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে যে, মোদির প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতি আরএসএসের ঐতিহ্যবাহী চিন্তাধারার থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। ভাগবতের বক্তৃতা যেন সেই মতকে আরও জোরালো করে তুলল।
সমালোচকরা বলেন, মোদির প্রশাসন ক্রমশ “ক্রোনি ক্যাপিটালিজম” বা ঘনিষ্ঠ পুঁজিপতিদের আশ্রিত অর্থনীতি তৈরি করছে, যাকে কংগ্রেস “মোদানি সিস্টেম” বলে আখ্যা দিয়েছে। প্রবীণ বিজেপি নেতা মুরলি মনোহর যোশীর প্রতিবেদনও সেই অসন্তোষের প্রতিফলন, যেখানে তিনি দেশের অর্থনীতির দুরবস্থা এবং উত্তরাখণ্ডের চারধাম প্রকল্পের ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরেছিলেন।
এই পটভূমিতে ভাগবতের বিজয়া দশমীর বক্তৃতা শুধুমাত্র এক ধর্মীয় বা সাংগঠনিক বার্তা নয়, বরং এক রাজনৈতিক অবস্থান, যা সরকারের প্রচারিত “অভূতপূর্ব উন্নয়ন”-এর বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম প্রতিবাদ।
ভাগবত আত্মনির্ভর ভারতের ধারণাকে সমর্থন করলেও ইঙ্গিত দেন, আজকের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সম্পূর্ণ স্বনির্ভরতা সম্ভব নয়। তিনি বলেন যে, গণবিক্ষোভের জন্ম ঘটে যখন সরকার জনগণের প্রতি উদাসীন ও অপ্রতিক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে, যেমন দেখা গিয়েছে নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশের মতো দেশে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভাগবতের এই মন্তব্য আসলে মোদি সরকারের প্রতি এক সতর্কতার সংকেত।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফল বদলে দিয়েছে বিজেপির অবস্থান। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে মোদি সরকার এখন নির্ভরশীল চন্দ্রবাবু, নীতীশদের মতো সুবিধাবাদী জোটসঙ্গীদের ওপর। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভাগবতও তাঁর হারানো কর্তৃত্ব ফিরে পাচ্ছেন।
অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের সময় যিনি নীরব উপস্থিতিতে ছিলেন, সেই ভাগবত এখন দৃঢ়ভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে ফিরে এসেছেন। মোদি বাধ্য হয়েছেন তাঁর প্রশংসায় প্রবন্ধ লিখতে, স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে আরএসএসের অবদান উল্লেখ করতে, এমনকি সংগঠনের শতবর্ষে ডাকটিকিট ও স্মারক মুদ্রা প্রকাশ করতে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ভাগবত মোদির ৭৫তম জন্মদিনে কোনও বিশেষ বার্তা বা অনুষ্ঠান করেননি, যা রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা সৃষ্টি করেছে।
সমালোচকদের মতে, মোদি সরকারের সবচেয়ে বিতর্কিত দিকগুলির একটি হল ইতিহাসের বিকৃতি। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে আরএসএস দূরে থেকেছে, এমনকি জাতীয় পতাকা ও সংবিধানের বিরোধিতাও করেছিল। ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে জনসংঘ (আরএসএস-ঘনিষ্ঠ দল) মাত্র ৩টি আসন পায়, যেখানে কংগ্রেস ৩৬৪টি আসন ও ৪৪.৯৯% ভোটে বিপুল জয়লাভ করে। এই ফলাফল তখনকার জাতীয় মানসিকতা স্পষ্ট করেছিল। ভারতের মানুষ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বদলে সংবিধানভিত্তিক গণতন্ত্রকে বেছে নিয়েছিল। বিশ্লেষকদের মতে, আজ মোদির সরকার আরএসএসকে বৈধতা দিতে সেই ইতিহাসকেই বিকৃত করছে।
ভাগবত তাঁর বক্তৃতায় “চরিত্রগঠন”-এর ওপর বিশেষ জোর দেন। তাঁর মতে, আরএসএস এমন মানুষ তৈরি করতে চায়, যারা সততার সঙ্গে সংগঠনের দর্শনকে বাস্তবায়িত করবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, একশো বছর পূর্ণ করেও আরএসএস কতজন বিশ্বমানের চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ, দার্শনিক বা সমাজসংস্কারক তৈরি করতে পেরেছে?
ভারতের আধুনিক ইতিহাসে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সর্দার প্যাটেল, বি আর আম্বেদকর— সবাই আরএসএসের মতাদর্শকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অমর্ত্য সেন, রোমিলা থাপার, অরুন্ধতী রায়, রঘুরাম রাজন, প্রতাপ ভানু মেহতা প্রমুখের মতো আধুনিক বুদ্ধিজীবীরাও মনে করেন, সংঘ পরিবারের দর্শন ভারতের সংবিধানসম্মত মূল্যবোধের পরিপন্থী।
ভাগবতের সামনে প্রশ্ন, বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলি কি সত্যিই আরএসএসের সেই ‘চরিত্রগঠন’-এর প্রতিফলন? দুর্নীতি, পক্ষপাত, সংখ্যালঘু-বিরোধী রাজনীতি এবং প্রশাসনিক হিংসা কি সেই চরিত্রেরই চিহ্ন?
ভাগবত বলেন, আরএসএস সমাজে ঐক্য চায়, কোনও ধর্ম বা সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ নয়। কিন্তু বিজেপি পরিচালিত সরকারগুলির মুসলমান-বিরোধী নীতি, বুলডোজার রাজনীতি এবং ঘৃণার বক্তব্য সেই কথার সঙ্গে খাপ খায় না।
যখন দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকরা কেন্দ্রীয় সংস্থার নজর এড়াতে বিজেপিতে আশ্রয় নেন, বা অপরাধে অভিযুক্ত তথাকথিত ‘বাবা’-রা সংঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে উঠে আসেন, তখন সমাজে সেই চরিত্রগঠনের আদর্শ প্রশ্নের মুখে পড়ে।
মোহন ভাগবতের এবারের বিজয়া দশমীর ভাষণ কেবল ধর্মীয় বা সাংগঠনিক বার্তা নয়, এটি রাজনৈতিক বার্তা, যা আরএসএস ও বিজেপির মধ্যে ক্ষমতার সমীকরণে নতুন অধ্যায় সূচিত করেছে।
ভাগবত যেখানে চরিত্র, নৈতিকতা ও সামাজিক ঐক্যের কথা বলেন, সেখানে মোদি সরকারের বাস্তব চিত্র সেই বক্তব্যের সঙ্গে গভীর বৈপরীত্য তৈরি করছে। এই বৈপরীত্যই হয়ত আজকের ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, আরএসএসের দর্শন বনাম মোদির বাস্তব রাজনীতি।