
তামিলনাড়ু সরকারের একটি ২৬ পাতার রিপোর্টে প্রকাশ চাঞ্চল্যকর তথ্য। কাঞ্চিপুরমে অবস্থিত শ্রেসান ফার্মাসিউটিক্যাল সংস্থার তৈরি ‘কোল্ডরিফ’ কাফ সিরাপ খেয়ে মধ্যপ্রদেশে ১৪ জন এবং রাজস্থানে ২ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এই কাফ সিরাপ তৈরির সময় সংস্থাটি ৩৫০টিরও বেশি নিয়ম ভেঙেছে এবং ভয়াবহ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাফ সিরাপ উৎপাদন চালিয়েছে বলে তদন্তে জানা গেছে।
তামিলনাড়ু ড্রাগস কন্ট্রোল ডিপার্টমেন্টের অফিসাররা গিয়ে দেখেন, কাফ সিরাপ তৈরির ঘরে কোনও কার্যকর এয়ার হ্যান্ডলিং ইউনিট ছিল না। বাতাস চলাচলের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না, আর যন্ত্রপাতিগুলো ছিল মরচেধরা ও নষ্ট। ফ্যাক্টরির নকশা এমনভাবে তৈরি ছিল যে, তাতে সহজেই ওষুধে দূষণ ছড়াতে পারত।
পরীক্ষকরা জানান, কারখানায় কোনও কোয়ালিটি অ্যাস্যুরেন্স বিভাগ ছিল না। ব্যাচ রিলিজের জন্য কোনও অনুমোদিত ব্যক্তিও নিযুক্ত ছিল না। পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হলে বা পণ্য ফেরত নেওয়ার জন্য কোনও SOP (Standard Operating Procedure) ছিল না। এছাড়াও কর্মীদের জন্য পোশাক বদলের নিয়ম, GMP ড্রেন, বিশুদ্ধ জলের ব্যবস্থা, পেস্ট কন্ট্রোল বা পরিষ্কারের কোনও সিস্টেমও রাখা হয়নি।
পণ্য করিডরেও এয়ার হ্যান্ডলিং ইউনিট কাজ করছিল না। সেগুলি এমন জায়গায় ফেলে রাখা হত, যা সহজেই ধুলো ও অন্যান্য দূষণে ভরে যেত। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হল, সংস্থাটি ৫০ কেজি প্রোপিলিন গ্লাইকল বিল ছাড়াই অবৈধভাবে কিনেছিল। পরীক্ষায় কাফ সিরাপে ডাইইথিলিন গ্লাইকল নামক এক ভয়ংকর বিষাক্ত শিল্প-রাসায়নিক পাওয়া গেছে। ডাইইথিলিন গ্লাইকল সাধারণত ব্রেক ফ্লুইড, পেইন্ট বা প্লাস্টিক তৈরিতে ব্যবহার হয় এবং অল্প পরিমাণেও এটি মানুষের শরীরের জন্য প্রাণঘাতী।
ফ্যাক্টরিতে তরল ওষুধ প্লাস্টিকের পাইপ দিয়ে স্থানান্তর করা হত, কোনও ফিল্টার সিস্টেম ছিল না। রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি সাধারণ ড্রেনে ফেলা হত। বিশুদ্ধ জলের ট্যাঙ্কগুলিও ছিল অত্যন্ত নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়।
তদন্তে দেখা যায়, কাঁচামাল পরীক্ষা ছাড়াই উৎপাদনে ব্যবহার করা হত। কোনও ভেন্ডর অনুমোদন বা ল্যাব টেস্টের ব্যবস্থা ছিল না। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ট্র্যাক করার জন্য ফার্মাকোভিজিল্যান্স সিস্টেমও গড়ে তোলা হয়নি। স্যাম্পলিং করা হত খোলা জায়গায়, যার ফলে দূষণ অবশ্যম্ভাবী ছিল।
পোকামাকড় ঢোকা রোধে কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়নি। ফ্লাই ক্যাচার বা এয়ার কার্টেনও অনুপস্থিত ছিল। উৎপাদন ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত কর্মী ছিল না এবং বিশ্লেষণ বা পরিষ্কারের পরীক্ষার পদ্ধতির সঠিক যাচাইও করা হয়নি।
এই ভয়াবহ অনিয়ম ধরা পড়ার পর ১ অক্টোবর থেকে রাজ্য জুড়ে কোল্ডরিফ কাফ সিরাপ বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে তামিলনাড়ু সরকার। বাজার থেকে সমস্ত স্টক তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ল্যাব পরীক্ষায় এই সিরাপকে ভেজাল ও বিপজ্জনক হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে।
সংস্থার কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছে সরকার এবং উৎপাদন আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। এই সিরাপের বিক্রি ও ব্যবহার স্থগিত করা হয়েছে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান ও তামিলনাড়ু সহ একাধিক রাজ্যে। ইতিমধ্যে তিনজন সরকারি আধিকারিককে সাসপেন্ড এবং রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলারকে বদলি করেছে মধ্যপ্রদেশ সরকার।
তামিলনাড়ু সরকারের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছে, যদি সংস্থাটি ওষুধ তৈরির মৌলিক নিরাপত্তা ও গুণমানের নিয়মগুলো সঠিকভাবে মানত, তাহলে এই ভয়াবহ শিশুমৃত্যুর ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল। এই ঘটনায় দেশজুড়ে সতর্কতা জারি করা হয়েছে এবং ওষুধ শিল্পে গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।