
সোমবার নাগরাকাটা পরিদর্শনে গিয়েছিলেন বিজেপি সাংসদ খগেন মুর্মু ও বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। খগেন মুর্মুর গাড়িতেই ছিলেন তখন শঙ্কর। অভিযোগ, আচমকা তাঁদের উপর হামলা চালায় একদল দুষ্কৃতী। কাল কেটে রক্ত ঝরতে থাকে খগেনের। তড়িঘড়ি তাঁকে চালসা হাসপাতালে নিয়ে যান শঙ্কর। প্রাথমিক চিকিত্সার পর শিলিগুড়িতে নিয়ে গিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সাংসদ, বিধায়কের পাশাপাশি তাঁদের রক্ষীদেরও মারধরের অভিযোগ ওঠে। এদিন দুপুরে শিলিগুড়ির বেসরকারি হাসপাতালে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে শঙ্কর ঘোষ ভর্তি থাকলেও শুধু খগেনের সঙ্গেই দেখা করেন মমতা। কথা বলেন চিকিৎসকদের সঙ্গে। বেরিয়ে জানান, সাংসদের অবস্থা এখন স্থিতিশীল রয়েছে। আঘাত তেমন গুরুতর নয়। কানের পিছন দিকে লেগেছে। বিজেপি সাংসদের দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন মমতা।
শনিবার রাতভর টানা ভারী বৃষ্টিতে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয় নাগরাকাটা সহ উত্তরবঙ্গের বেশ কিছু এলাকায়। ধস, রাস্তার উপর দিয়ে তিস্তা সহ একাধিক নদী বয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি খারাপ হয়। সোমবার নাগরাকাটা পরিদর্শনে যান খগেন ও শঙ্কর। অভিযোগ, সে সময় তাঁদের দিকে তেড়ে আসে কিছু মানুষ। বাঁশ, লোহার রড, পাথর দিয়ে মারধর করা হয়। ভাঙচুর করা হয় গাড়িতেও। গুরুতর আঘাত লাগে সাংসদ খগেন মুর্মুর। রক্তে ভেসে যান তিনি। আক্রান্ত হন বিধায়ক শঙ্কর ঘোষও। পরে শঙ্কর বলেন, ‘পরিকল্পিতভাবে আমাদের প্রাণে মেরে ফেলার চেষ্টা হয়েছিল। চালকের তৎপরতায় দ্রুত এলাকা থেকে বেরিয়ে আসতে পারি।’ বিজেপির অভিযোগ, রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল পরিকল্পিতভাবে এই হামলা চালিয়েছে। তবে অভিযোগ উড়িয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী উদয়ন গুহ বলেন, ‘এর সঙ্গে দলের কোনও সম্পর্ক নেই। সাংসদ-বিধায়ক হিসেবে ওরা ব্যর্থ, তারই ফলে মানুষ ক্ষোভ উগরে দিয়েছে।’
খগেন মুর্মুর অবস্থা খারাপ হতে থাকায় দিল্লি থেকে বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য নেতাদের কাছ থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট চেয়ে পাঠায়। রিপোর্ট চায় লোকসভার সচিবালয়ও। দিল্লি এইমসে স্থানান্তরিত করার কথাও ওঠে।
এই ঘটনায় যখন তৃণমূলের দিকে আঙুল তুলতে ব্যস্ত বঙ্গ বিজেপি, চারিদিকে চলছে প্রতিবাদ, ঠিক সেই সময় রাজ্যের সাংসদকে দেখতে পৌঁছে যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। শারীরিক অবস্থা ও আপডেট নিয়ে কথা হয় চিকিৎসকদের সঙ্গে। খগেনকে মমতা বলে আসেন, ‘যে কোনও রকম সাহায্য লাগলে জানাবেন’। মমতা কথা বলেন সাংসদের স্ত্রী এবং সন্তানের সঙ্গেও।
মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যে খুশি খগেনের পরিবার। তাঁরা জানান, কোথায় আঘাত পেয়েছেন সাংসদ, তার খোঁজ নিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পর তিনি চিকিৎসকদের ডেকে কথা বলেন। খগেনের বেডের পাশে দাঁড়ানো সাংসদ-পুত্রকে মমতা জিজ্ঞাসা করেন, ‘‘ওঁর কি ডায়াবেটিস রয়েছে? ইনসুলিন নেন? ওষুধ খান? টেক কেয়ার করেন? দেখান ভাল করে? খাওয়া-দাওয়া কন্ট্রোল করেন?’’ খগেনের ছেলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলেন। এর পর প্রবীণ সাংসদকে চিকিৎসকদের পরামর্শ মেনে চলতে বলেন মুখ্যমন্ত্রী। সাংসদের পরিবারের সদস্যদের জানান, যে কোনও প্রয়োজনে তিনি পাশে রয়েছেন। অন্যত্র চিকিৎসার প্রয়োজন হলেও যেন তাঁকে বলা হয়।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘এমনি ঠিক আছেন। সিরিয়াস কিছু নয়। যাঁদের ডায়াবেটিস থাকে, তাঁদের একটু পর্যবেক্ষণে বেশি থাকতে হয়। ওঁর একটু কানে বেশি লেগেছে। চিকিৎসকদের রিপোর্ট ইত্যাদি আমি দেখেছি। উনি এখন পর্যবেক্ষণে রয়েছেন। ওঁর ডায়াবেটিস আছে। ডায়াবিটিস কন্ট্রোল করতে হয়। আমি প্রার্থনা করেছি। ওঁকে বলেছি। ওঁর দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছি।’’
সাংসদকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে কি না, সাংবাদিকদের এই প্রশ্নে মমতা বলেন, ‘‘এমন সিরিয়াস কিছু নয়।’’
খগেন মুর্মুর বাঁ চোখের নীচের হাড়ে আঘাত লেগেছে বলে জানা যায়। স্বাভাবিক ভাবে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতর তুঙ্গে ওঠে। নাগরাকাটায় ওই ঘটনার নিন্দা করেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি সমাজমাধ্যমে লেখেন, ‘‘যে ভাবে আমাদের দলের সহকর্মীরা, যাঁদের মধ্যে এক জন বর্তমান সাংসদ ও বিধায়কও রয়েছেন, পশ্চিমবঙ্গে বন্যা ও ভূমিধসে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এটি তৃণমূল কংগ্রেসের অসংবেদনশীলতা এবং রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার করুণ রূপের স্পষ্ট প্রতিফলন।’’ এর পাল্টা মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা অভিযোগ করেন, উত্তরবঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যেও রাজনীতি করতে নেমেছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি সমাজমাধ্যমে বলেন, ‘‘এটা দুর্ভাগ্যজনক এবং গভীর উদ্বেগের যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যথাযথ তদন্তের অপেক্ষা না করেই একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের রাজনীতিকরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিশেষ করে যখন উত্তরবঙ্গের মানুষ ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধস পরবর্তী পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করছেন।’’
খগেন এবং শঙ্করের জখম হওয়ার অব্যবহিত পরে মুখ্যমন্ত্রী একটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘চারপাশের মানুষকে সহযোগিতা করুন। এই সময় কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা কাম্য নয়। আমরা একে অপরের পাশে থেকে একসঙ্গে এই সঙ্কটের মোকাবিলা করব।’’
খগেনকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে সেই সৌজন্যই দেখালেন মমতা। কার্যত ঘুরিয়ে দিলেন রাজনীতির খেলা।