
উৎপল পট্টনায়ক
বিহার বিধানসভার ভোটগ্রহণ আগামী ৬ এবং ১১ নভেম্বর। ২৪৩ কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ হবে দু-দফায়। আর ভোট গণনা ১৪ নভেম্বর। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, এবার প্রায় ৭.৪ কোটি ভোটার তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করবেন। এর মধ্যে রয়েছেন ১৪ লক্ষ নতুন ভোটার। প্রথম দফায় ১২১টি বিধানসভা কেন্দ্রে ভোট হবে, যেখানে বেশিরভাগ এলাকাই গ্রামীণ এবং বন্যাপ্রবণ। দ্বিতীয় দফায় ১২২টি আসন থাকবে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে।
বিহারে বর্তমানে নীতীশ কুমারের জেডিইউ নেতৃত্বাধীন এনডিএ ক্ষমতায় থাকলেও, এবার কিন্তু তীব্র চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে আরজেডি, কংগ্রেস ও বামদলগুলি নিয়ে তৈরি মহাগঠবন্ধন। এ বারই প্রথম বিহার ভোটে ২৪৩টি কেন্দ্রেই প্রার্থী দেবে বলে ঘোষণা করেছে আম আদমি পার্ট। সব মিলিয়ে বিহার ভোট ঘিরে এবার নতুন এক সমীকরণ তৈরি হতে চলেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যখন বিহারে ভোটের নতুন অঙ্ক বোঝার চেষ্টা করছেন, তখন নিঃশব্দে ফের প্রচারে চলে এসেছে MY Formula.। রাষ্ট্রীয় জনতা দলের তথা RJD -র প্রতিষ্ঠাতা লালু প্রসাদ যাদবের বহুল ব্যবহৃত মুসলিম-যাদব অঙ্ক। ৭৭ বছর বয়সী প্রবীণ রাজনীতিবিদ এখন তাঁর রার্ধক্যজনিত অসুস্থতার করাণে সেভাবে আর সক্রিয় নন রাজনীতিতে। তবে তাঁর আমলে ৩ দশক ধরে কিন্তু দাপিয়ে বেড়িয়েছে MY অঙ্ক। লালুর হাত থেকে ব্যাটন তুলে নিয়ে তেজস্বী যাদবও কিন্তু MY কে আঁকড়ে ধরেছেন।
MY সূত্র তথা অঙ্কটি বুঝতে হলে একটু অতীতে ফিরতে হবে। লালু যাদবের MY Formula তৈরি হয়েছিল দুটি M অর্থাৎ মণ্ডল এবং মন্দির নিয়ে। সেই ১৯৯০ সালে, দুটি ঘটনা ভারতীয় রাজনীতির গতিপথ বদলে দিয়েছিল। কেন্দ্রের বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং-এর জোট সরকার সমাজের পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের জন্য, সংরক্ষণ লাগু করতে মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করে। আর দ্বিতীয় ঘটনাটি হল, অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরির দাবিতে বিজেপির প্রবীণ নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা।
মণ্ডল এবং মন্দির, এই দুই রাজনৈতিক পদক্ষেপকেই কাজে লাগিয়ে শুধু বিহারেই নয়, জাতীয় রীতিমতো আলোড়ন তুলেছিলেন উচ্চাকাঙ্খী লালু প্রসাদ যাদব। পরে ১৯৯৭ সালে যখন রাষ্ট্রীয় জনতা দল তৈরি করেন, তখন তো একচেটিয়াভাবে কমবেশি ৩ দশক ধরে এর সুফল কুড়িয়েছেন।
১৯৯০ সালের আগস্টে, ভিপি সিং সরকার মণ্ডল কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার ফলে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের লোকেদের জন্য একধাক্কায় ২৭ শতাংশ চাকরি সংরক্ষিত হয়। এই পদক্ষেপে দেশজুড়ে তথাকথিত উচ্চবর্ণের ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিলেও, লালু যাদবের বিহারের জন্য, এটি ছিল একটি রাজনৈতিক জ্যাকপট। কারণ বিহারের ভোটারদের মধ্যে তখন প্রায় ৫২ শতাংশই ছিলেন সমাজের পিছিয়ে থাকা সম্প্রদায়ের জনগণ। মণ্ডল কমিশনের সংরক্ষণ তথাকথিত উচ্চবর্ণকে, পিছিয়ে পড়াদের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল।

আর লালু প্রসাদ যাদব, তখন বর্ণগত আধিপত্যের বিরুদ্ধে লড়াইকারী ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে উপস্থাপিত করেন। যার সুফল তখন থেকে প্রায় প্রতিটি নির্বাচনেই পেয়েছে লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল। মণ্ডল কমিশনের রেশ কাটতে না কাটতে, বিজেপির রাম মন্দির ইস্যু, আতঙ্ক ধরিয়েছিল মুসলিম ভোটারদের মনে। প্রবীণ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির রাম রথযাত্রা কিন্তু আটকে গিয়েছিল এই বিহারেই।
১৯৯০ সালের ২৩ অক্টোবর বিহারের সমস্তিপুরে রাম রথযাত্রাকে আটকে দেন মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব। প্রবীণ বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানিকে গ্রেফতার করে পাঠান হয় বিহার-বাংলা বর্ডারে থাকা মাসানজোেরের সরকারি অতিথিশালায়। ওই দিনেই পাটনার ঐতিহাসিক গান্ধী ময়দানে, মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ একটি বিশাল সমাবেশে ভাষণ দেন। সেখানে বলেছিলেন মানুষ মারা গেলে, মন্দিরের ঘণ্টা কে বাজাবে? মসজিদে নামাজ পড়বেই বা কে? বিহারে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়তে দেব না। ক্ষমতায় থাকি বা না থাকি, এই বিষয়ে কোনও আপস তিনি করবে না।
আদবানিকে ঘিরে এমন পদক্ষেপ এবং তার পর গান্ধী ময়দানের ভাষণ, রাতারাতি লালু প্রসাদ যাদব জাতীয় রাজনীতিতে বিখ্যাত করে তোলে। মুসলিমদের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন রক্ষকর্তা তথা ‘মসিহা’। বিদ্বৎসমাজেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন লালু যাদব। কারণ তিনিই একমাত্র মুখ্যমন্ত্রী, যিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য সংরক্ষণকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং একই সঙ্গে বিহারের সংখ্যালঘু মুসলিমদেরও ত্রাণকর্তা হিসেবে পদক্ষেপ করেছেন। বামপন্থীরাও লাল প্রসাদের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ।
মুসলিম-যাদব অঙ্কের এই সূত্র প্রথমবার পরীক্ষা দেয় ১৯৯১ সালে লোকসভা নির্বাচনে। বিহারের ৪০ লোকসভার মধ্যে ৩২ টি আসন জিতে নিয়েছিল লালু যাদবের তখনকার জনতা দল। বিহার ছাড়া দেশের আর সর্বত্র কিন্তু পরাজিত হয়েছিল জনতা দল। সেই সময়ে, বিহারে পশ্চাদপদ এবং অত্যন্ত পশ্চাদপদ বর্ণের ভোটার ছিল প্রায় ৫২ শতাংশ। আর মুসলিমরা ছিলেন ১২ শতাংশ।
কেন্দ্রের রাজীব গান্ধী সরকারের রাম মন্দিরের শিলান্যাসের অনুমোদন, ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছিল মুসলিম ভোটারদের উপর। অথচ কংগ্রেস কিন্তু বছরের পর বছর ধরে বিহারে উচ্চবর্ণের পাশাপাশি মুসলিম এবং হরিজন সহ অত্যন্ত পশ্চাদপদ বর্ণের ভোটারদের উপর নির্ভরশীল ছিল। তবে দুই ‘ম’ অর্থাত্ মণ্ডল এবং মন্দির, বিহারের সেই ভোটের অঙ্ককে পুরো বদলে দেয়। আর সেই বদলের নেপথ্যে লালু প্রসাদ যাদব। যিনি পিছিয়ে পড়া জাতি এবং মুসলমানদের কাছে তখন হয় উঠে ছিলেন মসিহা।
১৯৯৫ সালের বিহার নির্বাচনে, লালু যাদবের নেতৃত্বাধীন জনতা দল ১৬৭টি বিধানসভা আসন জিতেছিল, যা তাঁর MY Formula-র আরেকটি প্রমাণ। তারপর থেকে, কংগ্রেস এখনও বিহারের মুসলিম ভোটারদের নিজেদের দিকে টানতে হিমশিম খাচ্ছে। আর লালু যাদব জনতা দল ত্যাগ করে আরজেডি তৈরি করলেও বিহারের মুসলিম ভোটের একটি বড় অংশ কিন্তু তাঁর দিকেই।
২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আরজেডি বিহারে একক বৃহত্তম দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। কিন্তু তাদের জোটে থাকা কংগ্রেসের খারাপ ফল করায় মহাগঠবন্ধনকে ক্ষমতার বাইরেই থাকতে হয়। এনডিএ, নীতীশ কুমারের জেডিইউকে নিয়ে বিহারে সরকার গড়ে। কংগ্রেসের খারাপ ফলের বড় কারণ আসাদুদ্দিন ওয়াইসির এআইএমআইএম। আসাদুদ্দিনের দল এআইএমআইএম ৫টি কেন্দ্রে জিতে যায়। যদি সেই দলের ৪ জন বিধায়ক পরে আরজেডিতে চলে আসেন।
বিহারের রাজনীতিতে আসাদুদ্দিন ওয়াইসির দল বিরোধী মহাগঠবন্ধনে যোগদানের জন্য বারবার চেষ্টা চালালেও, আরজেডি কিন্তু এআইএমআইএমকে গ্রহণ করতে রাজি নয়। কারণ লালুপুত্র তেজস্বী যাদবও তাঁর বাবার মতোই ভোট বাক্সে MY Formula কে কাজে লাগাতে চান।
দুহাজার পঁচিশের ভোটের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে ৩৩ শতাংশ ‘এক্সট্রিমলি ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস’ (EBC) ভোট। যা এতদিন ছিল এনডিএ-র ঘাঁটি। এবার কিন্তু সেই ভোটব্যাঙ্কে নজর দিয়েছে তেজস্বী যাদবদের বিরোধী শিবিরও। অন্যদিকে মুসলিম ভোটারদের একটা অংশ এআইএমআইএম মতো বিকল্প দলের অনুসন্ধান করছে। এই প্রেক্ষাপটে বিহার নির্বাচনে MY সূত্র কতটা কাজে দেবে তা জানা যাবে আগামী ১৪ নভেম্বর, ভোটগণনার দিনে।