
কাবুলের তালিবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুতাক্কি আগামী ৯ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত নয়াদিল্লি সফরে আসছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা কমিটি থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর এই সফর সম্ভব হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরেও তিনি এমন ছাড়পত্র চেয়েছিলেন, কিন্তু তা মেলেনি।
রাশিয়ার মস্কো ফরম্যাট আলোচনায় অংশগ্রহণের পর তিনি দিল্লি পৌঁছাবেন বলে জানা গেছে। সফরকালে তাঁর সঙ্গে ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করের বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সফরকে ঘিরে কূটনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে—গত চার বছরে ভারত-তালিবান সম্পর্ক কীভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, এবং ভারতের কৌশলগত স্বার্থ কীভাবে রক্ষা করা যাবে।
তালিবানের উত্থানের পর ভারতের দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থান
২০২১ সালের আগস্টে তালিবান ক্ষমতা দখল করলে ভারত দ্রুত কাবুলে নিজের দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলো বন্ধ করে দেয়, ভিসা বাতিল করে এবং নাগরিকদের সরিয়ে আনে। তবুও, তালিবান সরকারের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখা হবে, তা নিয়ে তখনও দ্বিধা ছিল। ওই সময় ভারতীয় রাষ্ট্রদূত কাতারে তালিবান রাজনৈতিক দফতরের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভারতের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার আশ্বাস চান।
এরপর ২০২২ সালের জুনে বিদেশ মন্ত্রকের পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান বিভাগের যুগ্ম সচিব কাবুল সফর করেন এবং ভারতের প্রযুক্তিগত মিশন চালু হয়—যা মূলত মানবিক সহায়তা তদারকি করার জন্য গঠিত। ধীরে ধীরে এই সীমিত যোগাযোগ এখন বাস্তবতার অনিবার্য স্বীকৃতিতে রূপ নিয়েছে।
সম্পর্কের উষ্ণতা: কূটনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি
চলতি বছরের শুরুতে ভারতীয় বিদেশসচিব দুবাইয়ে মুতাক্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন—যা দুই দেশের মধ্যে প্রথম উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। আলোচনায় মানবিক সাহায্য, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং চাবাহার বন্দর ব্যবহার নিয়ে কথা হয়। তালিবান সরকারের বিদেশমন্ত্রক ভারতকে “গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক শক্তি” বলে বর্ণনা করে।
এরপর এপ্রিল মাসে পহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পর ভারতের প্রতিনিধিদল আবার মুতাক্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। তালিবান সেই হামলার নিন্দা জানায় এবং ফোনালাপে ভারতের বিদেশমন্ত্রী জয়শঙ্কর তাঁদের ধন্যবাদ জানান। পাকিস্তান-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতি ভারতের জন্য তালিবান সরকারের সঙ্গে সংলাপের আরও সুযোগ তৈরি করেছে।
আঞ্চলিক রাজনীতি ও ভারতের স্বার্থ
ভারত সবসময় আফগানিস্তানের সঙ্গে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের উপর গুরুত্ব দিয়েছে। তবে তালিবানের প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই নিরাপত্তা ঝুঁকি, বিশেষ করে আল-কায়েদা,আইএসকেপি, লস্কর-ই-তইবা ও জইশ-ই-মোহাম্মদ-এর উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থেকে যায়।
অন্যদিকে, রাশিয়া এ বছর প্রথম দেশ হিসেবে তালিবান সরকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। যদিও চীন, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এখনও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তারা তালিবানের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছে।
তালিবানের পক্ষে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো আন্তর্জাতিক বৈধতার প্রতীক হিসেবে কাজ করছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তালিবান এখন নিজেদের স্বাধীন পরিচয় তুলে ধরতে চাইছে। তবে ভারতের জন্য এটি সুযোগ যেমন, তেমনি চ্যালেঞ্জও—বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান-আফগানিস্তান ত্রিপাক্ষিক জোটের প্রভাব বিবেচনা করলে।
কূটনৈতিক অগ্রাধিকার ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ
বর্তমান বৈঠকে তালিবানপন্থী একজন রাষ্ট্রদূতকে নয়াদিল্লিতে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। এছাড়া মুতাক্কি ভারতের কাছে বেশি ভিসা প্রদান, বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আহ্বান জানাতে পারেন।
ভারতের প্রধান লক্ষ্য হবে নিজের নিরাপত্তা স্বার্থ নিশ্চিত করা এবং সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা পাওয়া। একই সঙ্গে আফগান জনগণের পাশে দাঁড়ানো ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখা ভারতের কূটনৈতিক ভারসাম্যের মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যতই উচ্চপর্যায়ের বৈঠক বেড়েছে, ততই প্রত্যাশা বেড়েছে যে ভারত শুধুমাত্র তালিবানের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে সীমাবদ্ধ না থেকে আফগান জনগণের উন্নয়নে দৃশ্যমান ভূমিকা নেবে এবং তালিবানকে নারীদের ও সংখ্যালঘুদের উপর থেকে কঠোর বিধিনিষেধ শিথিল করতে উৎসাহিত করবে।
তবে বড় প্রশ্ন রয়ে গেছে—ভারত কতটা প্রভাব খাটাতে পারবে, আর তালিবান কতটা আন্তরিকভাবে ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে—সেই উত্তর এখনো অনিশ্চিত।