
আমাদের রান্নাঘর যেন ময়দা ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। নরম নান, ফ্লাফি কেক, মচমচে সমোসা, বিস্কুট সবেতেই ময়দার ব্যবহার। কিন্তু এই মসৃণ ও বহুমুখী উপাদানের পেছনে রয়েছে এক জটিল প্রক্রিয়া ও কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকিও। অনেকেই না ভেবে ময়দা ব্যবহার করেন, কিন্তু পুষ্টিবিদরা বারবার এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সতর্ক করে থাকেন। আসুন, জেনে নেওয়া যাক ময়দা কীভাবে তৈরি হয়, কেন এটি গমের আটা থেকে কম স্বাস্থ্যকর, ময়দা কি একেবারে খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে? জানুন!
ময়দা তৈরি হয় ঠিক সেই একই গমের দানার ভেতরের অংশ বা এন্ডোস্পার্ম থেকে, যেখান থেকে আমরা আটা পাই। তবে প্রক্রিয়াজাতকরণের পার্থক্যই ময়দাকে আলাদা করে তোলে।
১. পরিষ্কার ও কন্ডিশনিং:- প্রথমে গমের দানা ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয় — পাথর, খোসা ও ধুলোবালি আলাদা করা হয়। এরপর সামান্য জল মিশিয়ে দানাগুলিকে কন্ডিশন করা হয়, যাতে বাইরের ভূষি ও ভেতরের সাদা অংশ সহজে আলাদা হয়।
২. পেষণ ও মিলিং :- পরিষ্কার করা গমের দানা রোলার মেশিনের মাধ্যমে ধাপে ধাপে পেষা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধীরে ধীরে ভূষি, জার্ম ও এন্ডোস্পার্ম আলাদা হয়। এরপর মোটা কণাগুলো আবারও পেষা হয় যতক্ষণ না কেবল সাদা স্টার্চি অংশটিই থেকে যায়।
৩. রিফাইনিং:- পেষার পর গুঁড়োকে বারবার ছাঁকা হয় যাতে সমস্ত ভূষি ও জার্ম বাদ পড়ে যায়। ফলে তৈরি হয় অতিসূক্ষ্ম, সাদা ময়দা।
৪. ব্লিচিং ও রাসায়নিক প্রক্রিয়া:- প্রাকৃতিক অবস্থায় আটা হালকা হলদেটে হয়। এই রঙ দূর করে একে উজ্জ্বল সাদা করতে অনেক প্রস্তুতকারক বেনজয়েল পারঅক্সাইড বা ক্লোরিন ডাই-অক্সাইড এর মতো রাসায়নিক দিয়ে ব্লিচ করেন। কিছু ক্ষেত্রে ময়দাকে আরও নরম ও ইলাস্টিক করতে মেচুরিং এজেন্টও ব্যবহার করা হয়।
৫. প্যাকেটজাত করা:- সবশেষে মসৃণ সাদা ময়দা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়।
ময়দা হল গমের দানার স্টার্চি অংশ, যেখানে ভূষি (ফাইবার) ও জার্ম (পুষ্টিগুণ) পুরোপুরি বাদ দেওয়া হয়। ফলে এতে কার্বোহাইড্রেট ছাড়া প্রায় কোনো পুষ্টিগুণ থাকে না।
বছরের পর বছর পুষ্টিবিদরা পরিশোধিত ময়দার অতিরিক্ত ব্যবহারের বিরুদ্ধে সতর্ক করে আসছেন। এর পেছনে রয়েছে বেশ কিছু স্বাস্থ্যগত কারণ।
১. ফাইবারের ঘাটতি:- পুষ্টিবিদরা জানান, ময়দায় প্রায় কোনো ফাইবার নেই। অতিরিক্ত ময়দা খেলে হজমের গতি কমে যায়, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেট ফাঁপা ও অনিয়মিত পায়খানার সমস্যা দেখা দিতে পারে।
২. রক্তে শর্করার হঠাৎ বৃদ্ধি:- ময়দার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক বেশি। এটি দ্রুত গ্লুকোজে ভেঙে রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়। তাই ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ময়দা বিশেষভাবে ক্ষতিকর।
৩. ‘ফাঁকা’ ক্যালোরি:- ময়দা তৈরির সময় গমের প্রায় সব ভিটামিন, মিনারেল ও ফাইবার বাদ চলে যায়। ফলে যা থাকে তা মূলত স্টার্চ বা শক্তি – কিন্তু পুষ্টি নেই বললেই চলে।
৪. ওজন বৃদ্ধি ও মিষ্টি খাওয়ার তাগিদ:- ময়দা খুব দ্রুত হজম হয়, সঙ্গে সঙ্গে শরীরে শর্করার উত্থান ঘটায়, কিন্তু সেই প্রভাব বেশিক্ষণ থাকে না। ফলে অল্প সময়েই আবার ক্ষুধা লাগে, মিষ্টি বা কার্বোহাইড্রেটের প্রতি আকর্ষণ বাড়ে। দীর্ঘমেয়াদে এটি অতিরিক্ত খাওয়া, ওজন বৃদ্ধি ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্সের দিকে ঠেলে দেয়।
৫. সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি:- গবেষণায় বলা হয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে ময়দা খেলে মেটাবলিক সমস্যা, স্থূলতা ও হৃদরোগ-এর ঝুঁকি বাড়ে। এছাড়াও, ব্লিচিংয়ের জন্য ব্যবহৃত রাসায়নিকের সামান্য অংশ শরীরে গিয়ে হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
তাহলে কি ময়দা সবসময় খারাপ?
একেবারেই তা নয়। যদি আপনার প্রতিদিনের খাদ্যতালিকা পুষ্টিকর ও ফাইবারসমৃদ্ধ হয় তাহলে, মাঝে মাঝে উৎসবের সময় বা কোনো বিশেষ খাবারে সামান্য ময়দা খাওয়া ক্ষতিকর নয়। সমস্যা তখনই, যখন নিয়মিত রুটি, পাউরুটি, পিজ্জা, পাস্তা, নুডলস, বিস্কুটের মতো প্যাকেটজাত ময়দা-ভিত্তিক খাবার বেশি পরিমাণে খাওয়া হয়।
আপনি চাইলে ঘরে রান্নার সময় ময়দার সঙ্গে গমের আটা বা মিলেটের আটা মিশিয়ে ব্যবহার করতে পারেন। এতে ফাইবার ও পুষ্টিগুণ বাড়বে, আবার ময়দার টেক্সচারও পুরোপুরি হারাবে না।
কিছু ব্র্যান্ড এখন আয়রন ও বি-ভিটামিন সমৃদ্ধ ফোর্টিফাইড ময়দা বিক্রি করছে, যদিও তাতেও ফাইবার থাকে না।
যদি আপনি ময়দা কমাতে চান, বাজারে অনেক ভালো বিকল্প রয়েছে
গমের আটা:- ফাইবার, ভিটামিন ও খনিজে ভরপুর। রুটি ও বেকিং-এর জন্য আদর্শ।
বেসন:- উচ্চ প্রোটিন, গ্লুটেন-ফ্রি, নোনতা স্ন্যাকসের জন্য উপযুক্ত।
রাগি, জোয়ার বা বাজরার আটা: মিলেট আটা ফাইবার ও খনিজে সমৃদ্ধ।
ওটস বা বাকউইট আটা: প্যানকেক, মাফিন ইত্যাদিতে দারুণ লাগে।
বাদাম বা নারকেল আটা: কম কার্বোহাইড্রেট ও কিটো ডায়েটের জন্য জনপ্রিয়।
এই আটা গুলো শুধু পুষ্টিগুণই বাড়ায় না, খাবারে নতুন স্বাদ ও টেক্সচারও নিয়ে আসে।
ময়দা বিষ নয়, তবে এটিকে “স্বাস্থ্যকর” বলাও ভুল। এর নরম টেক্সচার ও ব্যবহারিক সুবিধা একে রান্নাঘরের জনপ্রিয় উপাদান বানিয়েছে, কিন্তু ফাইবার ও পুষ্টির অভাবের কারণে এটি পরিমিতভাবে খাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।