
দিব্যেন্দু ঘোষ
পাণ্ডুলিপিকে ‘বন্দি’ রাখতে চেয়েছেন ৯০ বছর! অনন্তকালের প্রেক্ষিতে ৯০ বছর এতই ক্ষুদ্র যে, সে আসবে আর যাবে। কিন্তু মানবেতিহাসে ৯০ বছরের পথ এতটাই দীর্ঘ যে, পৃথিবীর বেশিরভাগ মানুষ সেই পথ পেরোতে পারে না। ক’জন মানুষই বা বেঁচেবর্তে থাকে ৯০ বছর! যত দিন যাচ্ছে, বিশ্বজুড়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন তত দ্রুত হচ্ছে। বাড়ছে ভোগবিলাস এবং দৈনন্দিন যাপনের আরাম এবং গতি। বাড়ছে পৃথিবীজুড়ে সভ্যতার সংকট, জীবনের অনিশ্চয়তা, প্রত্যয় ও সংশয়ের, মূল্যবোধ ও আদর্শের বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জাগছে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের নতুন প্রশ্ন। পাওয়া যাচ্ছে সেসব প্রশ্নের অবিশ্বাস্য উত্তর কিংবা নিরুপায় নিরুত্তর। এমন এক সর্বগ্রাসী দ্রুত বিবর্তনের প্রেক্ষিতে প্রাচীন সময়ের ‘ক্লাসিক’ কীর্তির স্থায়িত্ব আমাদের সাধারণ ভাবনায় আসে না। আজ যা লিখছি, আগামিকাল তা ঠোঙা, এই ভাবনার ভরসাতেই আমরা যে-যার কাজ করে যাচ্ছি। মিলান কুন্দেরা সেজন্যই তো তাঁর ‘ইম্মর্ট্যালিটি’ বইতে উড়িয়ে দিয়েছেন অনন্তজীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ঝাড়া হাত-পা হয়েছেন ‘অস্তিত্বের অসহনীয় হালকামি’ বা ‘দ্য আন্বেয়ারেব্ল লাইটনেস অফ বিয়িং’ দর্শনে। তবে কাফকা আরও বেপরোয়া জীবন ও সাহিত্যবোধের পরিচয় দিয়ে বন্ধুকে বলেছিলেন, যা ছাইপাঁশ লিখেছি, সব পুড়িয়ে ফেলো। কিছুই যেন না থাকে। তবে যে বাঙালি লেখক লেখেন ইংরেজি ভাষায়, তাঁর কল্পনা এবং আত্মবিশ্বাস উড়েছে ভিন্ন আকাশে। তিনি বলেছেন, তাঁর একটি পাণ্ডুলিপি তিনি ‘বন্দি’ রাখতে চান আগামী ৯০ বছর। তবে নিটোল নিঃসঙ্গতায় নির্বাসিত নয়, তাঁর পাণ্ডুলিপির সঙ্গে থাকবে ওশান ভুয়ং, মার্গারেট অ্যাট্উড এবং নোবেলজয়ী হান কাংয়ের তিনটি পাণ্ডুলিপি। ৯০ বছর পরে, ২১১৪ সালে এই চারটি পাণ্ডুলিপি পড়ার সুযোগ পাবে এই চারজন লেখকের ভক্ত-পাঠকরা।
কেন ৯০? স্কটল্যান্ডের প্রকৃতিপ্রেমিক, দৃশ্যশিল্পী কেটি প্যাটারসনের রোপণ করা এক হাজারটি স্প্রুস গাছ ৯০ বছরে পৌঁছবে পূর্ণ যৌবনে। এবং এই ঘটনাটি ঘটবে নরওয়ের অস্লোতে, যেখানে নোবেল কমিটির অফিস। প্রশ্ন উঠতেই পারে, কোথায় ৯০ বছরের ধূসর পাণ্ডুলিপি আর কোথায় ৯০ বছর পর সবে যৌবনপ্রাপ্ত স্প্রুস বৃক্ষসারি? কিন্তু ওদের রক্তের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এবং মূলে অস্লো নগর কর্তৃপক্ষ। অমিতাভ ঘোষের ‘ফিউচার লাইব্রেরি প্রোজেক্ট’-এর সঙ্গে অস্লো নগর কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি এই মর্মে স্বাক্ষরিত হয়েছে যে, অস্লো সাধারণ গ্রন্থাগারে এই পাণ্ডুলিপিগুলি একটি কক্ষে সংরক্ষিত থাকবে ৯০ বছর। এবং তারপরে সেগুলি ছাপা হবে এই স্প্রুস গাছের শরীর-প্রসূত কাগজ থেকে।
হুম, এটাই অমিতাভ ঘোষ। ফিকশন ও নন-ফিকশনের একাধিক মাস্টারপিস বেরিয়েছে তাঁর হাত থেকে। দ্য সার্কেল অফ রিজন, দ্য শ্যাডো লাইনস, ইন অ্যান অ্যান্টিক ল্যান্ড, ক্যালকাটা ক্রোমোজোম, কাউন্টডাউন, ড্যান্সিং ইন কম্বোডিয়া অ্যান্ড আদার স্টোরিজ, দ্য গ্লাস প্যালেস, দ্য ইমাম অ্যান্ড দ্য ইন্ডিয়ান, দ্য হাংরি টাইড, সি অফ পপিজ, রিভার অফ স্মোক, ফ্লাড অফ ফায়ার, গান আইল্যান্ড-এর মতো বইয়ে তিনি গেঁথে দিয়েছেন আপামরের জীবনদর্শন। এক অবিশ্বাস্য লেখক-সত্তায় ভর দিয়ে তিনি বিশ্বের দরবারে আসীন। তাই তাঁর নাম উচ্চারিত হতে বাধ্য হয়েছে নোবেল কমিটির কাছে।
THE BERLINER ওয়েবসাইটে ম্যাথিল্ড মন্টপেটিটের একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর লেখায় বেশ কিছু তথ্য উঠে এসেছে। তিনি জানান, চার বছর ধরে তাঁর বুক ক্লাব প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার কে জিতবেন, তা অনুমান করার জন্য একটি পুল পরিচালনা করছে। গত তিনবারই তাঁর অনুমান সত্য হয়েছে। ২০১৯ সালে পিটার হান্ডকে তো ২০২০ সালে লুইস গ্লুক। ২০২১ সালে আবদুলরাজাক গুরনাহ, ২০২২ সালে অ্যানি আর্নো। মানে একবার পুরুষ সাহিত্যিক তো অন্যবার নারী সাহিত্যিক। কোরিয়ার হান কাং গত বছর জিতেছিলেন, তাই এ বছরের বিজয়ী হবেন একজন পুরুষ। সেই পুরুষ লেখকটি কে? ম্যাথিল্ড মন্টপেটিটের প্রাথমিক অনুমান, বিজয়ী লেখক হতে পারেন ভারতীয় অমিতাভ ঘোষ। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল বিজয়ী হওয়ার পর আর কোনও ভারতীয় এ পুরস্কার পাননি।
অমিতাভ ঘোষ কল্পকাহিনি ও অ-কল্পকাহিনি উভয়ই লেখেন। ইতিমধ্যেই অনেক বড় পুরস্কার জিতেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, উপনিবেশবাদ, আফিম যুদ্ধ ও সমসাময়িক প্রভাব সম্পর্কে তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি, সেটি নোবেল কমিটি পছন্দ করে। তিনি বিজেপি সম্পর্কে স্পষ্টভাষী, কিন্তু বিদেশে থাকেন, তাই রাজনীতিতে খুব বেশি বিভ্রান্ত নন। ম্যাথিল্ড মন্টপেটিট এরপরই ভারতীয়দের হতাশ করেছেন এই বলে, তিনি এত কিছুর পরও অমিতাভকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। তিনি সে জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। বাদ দেওয়ার কারণ কী? নোবেল কমিটি তাঁদেরই পুরস্কার দেয়, যাঁদের খুব কম পাঠক চেনেন। তারা ‘চমক’ দিতে পছন্দ করে, এটা মনে রাখতে হবে।
নরওয়েজিয়ান নাট্যকার ইয়ান ফসে ২০২৩ সালে নোবেল পুরস্কার জেতেন। ২০২১ সালে তাঞ্জানিয়ান-ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আবদুলরাজাক গুরনা জয়ী হন। কিন্তু তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেও বেশির ভাগ সাহিত্যমোদীই তাঁদের পুরস্কার পাওয়ার আগে চিনতেন কি? সবাইকে ‘রত্ন’ চিনতে হবে কেন? আর সবাই যদি ‘রত্ন’ চিনে ফেলে, তাহলে আর নোবেল কমিটির মতো ‘অমূল্য রত্ন’ কেন থাকবে? বিষয়টা সে রকমই।
সাহিত্যে নোবেল রাজনৈতিক। অথচ এটি রাজনীতিতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করে না। প্রায়ই বিজয়ীদের তাঁদের কাজের সামাজিক সম্পৃক্ততার কারণে নির্বাচিত করা হয়। যেমন নারীবাদ, উত্তর-উপনিবেশবাদ, বাস্তুতন্ত্র ইত্যাদি। তার মানে এই নয় যে বর্তমান সময়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। বরং এসব থেকে বিরত থাকতে হবে, যদি পুরস্কার পেতে হয়। কয়েক বছর ধরে রাশিয়ান, ইউক্রেনীয়, আরবি বা হিব্রু থেকে কোনও বিজয়ী নেই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তারা কখনই সেই ব্যক্তিকে নোবেল পুরস্কার দেবে না, যাঁকে সবাই নোবেল পুরস্কার পাবেন বলে মনে করেন। ফিলিপ রথ, ভ্লাদিমির নাবোকভ, মিলান কুন্দেরার ভাগ্যও এমনই ছিল। হারুকি মুরাকামি, কার্ল ওভ নাউসগার্ড ও মার্গারেট অ্যাটউডও আর কখনও নোবেল জিততে পারবেন বলে মনে হয় না।
সুইডিশ নোবেল কমিটি ভৌগোলিক ও ভাষাগতভাবে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে এবং ভাবটা এ রকম যে মার্কিনদের ঘৃণা করে। তবে আগে তেমন করত না। ২০১৬ সালে মার্কিন গায়ক বব ডিলান জেতার পর ২০২০ সালে কবি লুইস গ্লুক সম্মানিত হন। তবে অনেক আগে ১৯৯৩ সালে টনি মরিসন এবং ১৯৬২ সালে জন স্টেইনবেক জিতেছিলেন সাহিত্যে নোবেল।
অমিতাভ ঘোষের সঙ্গে যে নামগুলো নিয়ে আলোচনা জোরদার তাঁরা হলেন জেরাল্ড মুরনানে, অস্ট্রেলীয় গদ্যকার, হাঙ্গেরির ঔপন্যাসিক লাসজলো ক্রাজনাহোরকাই, রোমানিয়ার মিরসিয়া কার্তেরেস্কু, কানাডার কবি অ্যান কারসন বা মেক্সিকোর ক্রিস্টিনা রিভেরা গারজা, চিনের কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক ক্যান জুয়ে, জাপানের সমসাময়িক কালের প্রভাবশালী নারী লেখকদের অন্যতম হিরোমি ইতো। আবার সিরিয়ার এক সাহিত্যিক রয়েছেন তালিকায়। অনেক দিন ধরেই আলোচনায় আছেন সিরিয়ার কবি আলি সইদ অ্যাডোনিস। এ সময়ের আরব সাহিত্যের প্রধান কবিদের অন্যতম তিনি। আরব সাহিত্য বহু বছর থেকে সমাদৃত হচ্ছে না নোবেল কমিটির বিবেচনায়, সে জন্য এবার তার নামও রয়েছে আলোচনায়। আফ্রিকা বাদ যাবে কেন? তাই রয়েছে সোমালিয়ার ঔপন্যাসিক নুরুদ্দিন ফারাহের নাম। ইউক্রেনীয় লেখক ও বুদ্ধিজীবী আঁদ্রে কুরকভের নামও আলোচনায়।
হারুকি মুরাকামি, হিরোমি ইতো, ইওকো ওগাওয়া, ইয়োকো তাওয়াদা, বানানা ইয়োশিমোতোর মধ্যে কেউ একজন পেয়ে যেতে পারেন এবারের সাহিত্যে নোবেল। মারিয়া ট্রেজলিং বা জি একেলুন্ডের মতো বিশেষজ্ঞরা একমত যে, নোবেল পুরস্কারের সাহিত্যের ওপর খুব বেশি সরাসরি প্রভাব নেই এখন আর। এটি আসলে সাহিত্যের কোনও স্রষ্টাকে বিশেষ স্পটলাইটেও নিয়ে আসে না। তাই নোবেল কমিটি “সিরিয়াস” সাহিত্যের বাইরে পা রাখতেই পারে, যেমনটি তারা বব ডিলানকে পুরস্কার দেওয়ার সময় করেছিল। কোনও বিজ্ঞান-কল্পকাহিনি লেখকও পেয়ে যেতে পারেন সাহিত্যে নোবেল, যেমন এন কে জেমিসিন বা নেদি ওকোরাফোর!
তবে দৌড়ে সবার থেকে এগিয়ে অমিতাভ ঘোষ। পাঠক, বই বিক্রেতা, অনুবাদক, সম্পাদক থেকে শুরু করে লেখকদের ভবিষ্যদ্বাণীর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছেন অমিতাভ। ২০১০ সালে মারিও ভার্গাস লিয়োসার পর থেকে স্প্যানিশ ভাষার কোনও লেখক নোবেল পাননি। তাই স্প্যানিশ ভাষার সাহিত্যও এ বছর গুরুত্ব পেতে পারে। সুইডিশ অ্যাকাডেমি সব সময়ই বলে, সাহিত্যের মানই নোবেল পুরস্কারের মূল ভিত্তি। তা প্রমাণিতও। ৬ সদস্যের জুরির সভাপতি ৭৬ বছর বয়সি আন্ডার্স ওলসন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এলেন ম্যাটসন, অ্যান সুয়ার্ড, স্টিভ সেম-স্যান্ডবার্গ, আন্না কারিন পাম এবং সচিব ম্যাটস মালম।
প্রতি বছর জুন থেকে অগস্ট পর্যন্ত মনোনীত লেখকদের কাজ পড়ে দেখেন জুরি ও তাঁদের উপদেষ্টারা। সেপ্টেম্বরে শুরু হয় চূড়ান্ত আলোচনা। আজ জানা যাবে, কার হাতে উঠবে ২০২৫ সালের সাহিত্য নোবেল।

