
স্নিগ্ধা চৌধুরী
যাঁর কণ্ঠে বজ্রধ্বনি, চোখে অগ্নি, আর উপস্থিতিতেই থমকে যায় সময়, আজ ভারতীয় চলচ্চিত্রের সেই মহারাজ ৮৩ বছরে পা রাখলেন।
অমিতাভ বচ্চন শুধু একটি নাম নয়, এক পুরো যুগের প্রতিচ্ছবি, এক চলমান মহাকাব্য। প্রথম লাইট জ্বলতেই, ক্যামেরার সামনে তিনি ছিলেন শুধু মুখ নয়, অনুভূতির মহাসাগর। সংলাপের শব্দ, চোখের দৃষ্টি, অভিব্যক্তির জাদু সবই মিশে এক অমর ছাপ রেখে যায়। ৮৩ বছর বয়সেও তিনি তরুণ হৃদয়ের দীপ্তিতে আলোকিত, তাঁর প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সিনেমা আজও আমাদের মনকে স্পর্শ করে।
১৯৭৩ সালে জঞ্জির মুক্তি পেল আর জন্ম নিল “অ্যাংরি ইয়ং ম্যান”-এর যুগ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে একা লড়ে যাওয়া এক পুলিশ অফিসার, যাঁর নীরব প্রতিশোধের আগুনে ভারতীয় দর্শক নতুন এক নায়ককে পেল।
তারপর এলো দিওয়ার। দুই ভাই, দুই পথ, এক মা। সেই ছবির সংলাপ, “মেরে পাস মা হ্যায়i”, কেবল সিনেমার নয় ভারতীয় হৃদয়ের এক অমর সুর।
শোলে তাঁকে দিল এক শান্ত নায়কের অবয়ব জয়। কম কথা, গভীর চোখ, নিঃশব্দ সাহস। গব্বরের বন্দুকের আওয়াজের মধ্যেও তাঁর নীরবতা যেন প্রতিরোধের প্রতিধ্বনি। আর ডন রহস্যে মোড়া এক জগৎ, যেখানে তিনিই অপরাধী, আবার তিনিই নায়ক।যেন জীবনেরই রূপক সঠিক-ভুলের সীমারেখা অস্পষ্ট, কিন্তু তাঁর উপস্থিতি স্পষ্টতম আলো।
একের পর এক অভিমান, চুপকে চুপকে, সিলসিলা,কভি কভি। এখানে তিনি প্রেমিক, কবি, মানুষ। যেখানে আবেগের সূক্ষ্ম রেখা ছুঁয়ে যায় মনের গভীরতা। কভি কভি মেরে দিল মে খেয়াল আতা। এই গানের শব্দে আজও তাঁর কোমল মুখখানি ভেসে ওঠে যেন সময় থেমে গেছে সেই সুরে।
কিন্তু অমিতাভ মানেই পুনর্জন্ম।
যখনই সবাই ভেবেছে, “এবার শেষ,” তিনি তখনই যেন নতুন জীবন পেয়েছেন। অগ্নিপথ সেই পুনর্জন্মের মন্ত্র।
তারপর এল শাহেনশা। পেলাম তুখোড় আর এক সংলাপ। ” রিস্তে মে তো হম তুমহারে বাপ লাগতে হ্যায়। নাম হ্যায় শাহেনশা।“ এ যেন শুধুই সংলাপ নয়, এক ঘোষণা বলিউডে একটাই সম্রাট আছেন।
তারপর সময় বদলাল, কিন্তু অমিতাভের দীপ্তি নয়। বাগবানে– তিনি বৃদ্ধ পিতার চোখে সন্তানদের ক্ষুদ্র মানসিকতার বেদনা ফুটিয়ে তুললেন।
ব্ল্যাক–এ তিনি শেখালেন, অন্ধকারেরও ভাষা আছে, ভালোবাসারও আলোর মতো শক্তি আছে। চিনি কম- তিনি হাসলেন, পা–তে উল্টে দিলেন বয়সের সমীকরণ, আর পিঙ্ক–এ তিনি আবার সমাজকে আয়না দেখালেন
“নো মিনস নো।” এই তিনটি শব্দেই লুকিয়ে আছে তাঁর মানবিক মহত্ত্ব।
টেলিভিশনে কৌন বনেগা ক্রোড়পতি তাঁকে পৌঁছে দিল ঘরে ঘরে, প্রতিটি পরিবারের অন্দরমহলে। “লক কিয়া জায়ে?” এই প্রশ্নের মধ্যেও আছে এক উষ্ণ স্নেহ, এক প্রেরণার ভাষা। তিনি শুধু প্রশ্ন করতেন না, মানুষকে সাহস দিতেন নিজেদের উত্তর খুঁজে নিতে।
আজ যখন তিনি ৮৩-তে, তাঁর মুখে সময়ের বলিরেখা, কিন্তু চোখে এখনো আগুন। তিনি যেন নিজেরই সংলাপের প্রতিমূর্তি। “ম্যায় আজ ভি ওহি করতা হুঁ, যো মেরে দিল কেহেতা হ্যায়।“ জীবনকে এত রঙে, এত চরিত্রে, এত ভঙ্গিতে তিনি যেভাবে ছুঁয়েছেন, তা আর কেউ পারেননি।
‘জলসা’ র বাইরে আজও অগণিত ভক্ত ভিড় জমায়।ফুলের তোড়া, পোস্টার, গান! কেউ বলেন ডন এখনো অপরাজিত, কেউ বলেন বিজয় এখনো ন্যায়ের প্রতীক, কেউ বলে অমিতাভ মানেই আশ্বাস। যতদিন এই নাম থাকবে, ততদিন বলিউড থাকবে। আজকের এই দিনে তাঁকে শুভেচ্ছা জানানো মানে শুধু জন্মদিনের শুভেচ্ছা নয়, এক শিল্পযুগকে প্রণাম জানানো। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, ব্যর্থতা মানেই শেষ নয় বরং সেটাই পরবর্তী সূর্যোদয়ের পূর্বাভাস।
অমিতাভ বচ্চন একটি নাম, একটি প্রতীক, এক চিরন্তন আলো। বয়স ৮৩, অথচ মনের ভিতর এখনো ৩০-এর উন্মাদনা। ভারতীয় চলচ্চিত্রের চিরতরুণ এক ব্যক্তিত্ব। তাঁর কণ্ঠে এখনো প্রতিধ্বনিত হয় এক জীবনের তীব্র আহ্বান, “পিকচার আভি বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত।”