
স্নিগ্ধা চৌধুরী
ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া কেবল একটি পারিবারিক উৎসব নয়, এটি হলো প্রেম, স্নেহ এবং সম্মানের এক পৌরাণিক স্মৃতি। কালীপুজোর আনন্দের পর এই দিন আসে, যেন যেন দেবতাদের আশীর্বাদময় মুহূর্তগুলো আমাদের জীবনে অবতারিত হয়। বাঙালির ঘরে ঘরে ভাইফোঁটার নামই যেন আনন্দের প্রতীক, আর অন্য অঞ্চলে ভাইদুজ নামেও পরিচিত এই দিন। নামের পার্থক্য থাকলেও মূল ভাবনা এক ভাই ও বোনের সম্পর্কের পবিত্রতা রক্ষা ও ভাইদের মঙ্গল কামনা।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে সূর্যদেব ও দেবী শরন্যুর পুত্র ও কন্যা ছিলেন যম ও যমুনা। যমুনা নদীও তারই নামানুসারেই। যমুনা তার প্রিয় ভাই যমের সুস্বাস্থ্য, দীর্ঘায়ু ও সুখের জন্য কপালে ফোঁটা দিতেন। শুধু ফোঁটা নয়, তিনি নিজ হাতে রান্না করা সুস্বাদু পদও খাওয়াতেন। একবার কার্ত্তিক মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে যম, ব্যস্ততার পরও, তার দিদি যমুনার ঘরে হাজির হন। আনন্দ ও মমতার ভেলায় ভেসে যমুনা তার ভাইকে কপালে ফোঁটা দেন। সেই দিনই ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা ভাইফোঁটার সূচনা হয়, যা যুগে যুগে পরিবারের ঘরে ঘরে পালনীয় হয়ে ওঠে।
ভাইফোঁটার মধ্যে শুধু কপালে ফোঁটা দেওয়াই নয়, এটি হলো আবেগ, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতার এক বিশেষ প্রকাশ। দিদি-বোনেরা ভাইদের সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করেন, প্রার্থনা করেন তাদের জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি বর্ষিত হোক। ভাইদেরও দায়িত্ব থাকে দিদি-বোনাদের প্রতি সদাচরণ করা, কোনো অনৈতিক বা অন্যায় আচরণ করা হলে যমরাজ সেই ন্যায়বিচার করেন। এমনভাবে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া মানব জীবনে ন্যায়, ভালোবাসা ও সম্মানের শিক্ষা দেয়।পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী যমুনার জলে স্নান করলে নরক যাত্রা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। তাই বহু পরিবার এই দিনে শুভতা ও পবিত্রতার জন্য যমুনার জলে স্নান করেন। আবার সূর্যদেবকে অর্ঘ্য অর্পণ করলে ভাইদের জন্য আশীর্বাদ আরও সমৃদ্ধ হয়। এই আচার অনুষ্ঠান শুধু রীতি নয়, এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষণে ভাই-বোনের সম্পর্ককে জাগ্রত রাখে।
ভাইফোঁটা কেবল আনন্দের দিন নয়, এটি হলো আবেগের, ইতিহাসের ও পৌরাণিক কাহিনীর মিলনে গঠিত এক সোনালি অনুষ্ঠান। এই দিনে ভাই-বোন একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে, মনের কথা প্রকাশ করে, এবং সম্পর্কের গভীরতা উপলব্ধি করে। ছোট ছোট পদ, হাসি আর খুশির মুহূর্তগুলো পরিবারকে আরও কাছের করে তোলে।আজও যম ও যমুনার সেই প্রাচীন ভালোবাসার উৎসবের ছোঁয়া আমাদের ঘরে আসে। প্রতিটি ফোঁটা, প্রতিটি মিষ্টি পদ, প্রতিটি হাসি ও শুভেচ্ছা সবই সেই পৌরাণিক আবেশের অংশ। তাই ভাইফোঁটা শুধুই উৎসব নয়, এটি হলো ইতিহাস, বিশ্বাস এবং মানবিক আবেগের এক অপরিসীম প্রজ্বলিত রূপ, যা প্রতিটি বছর আমাদের মনে করিয়ে দেয়, পরিবারের ভালোবাসা ও একে অপরের জন্য সতর্ক দৃষ্টি জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
