সোমবার গোটা বিশ্বের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের অনেককে কাঁদিয়ে বিদায় নিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস। তাঁর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পর গোটা বিশ্বের নজর এখন তাঁর উত্তরসূরির দিকে। ইতিমধ্যেই সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে।এমনকি এমন কথাও উঠছে, ইতিহাসে প্রথমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পোপ নির্বাচিত হতে পারেন কার্ডিনাল রেমন্ড লিও বার্ক, যিনি একজন কট্টর সামাজিক রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত।এবার এশিয়া বা আফ্রিকার একজন পোপ নির্বাচনের সম্ভাবনাও রয়েছে। শেষ ইতালীয় পোপ জন পল I ১৯৭৮ সালে মারা যান। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কোনও ইতালীয় পোপ নির্বাচিত হননি।
পোপ ফ্রান্সিস ছিলেন একজন সংস্কারমুখী।নির্বাচিত হওয়ার মুহূর্ত থেকেই ফ্রান্সিস স্পষ্ট করে দেন, তিনি পোপ হিসেবে অন্যভাবে কাজ করবেন। ২০১৩ সালের ১৩ মার্চ পোপ ফ্রান্সিস সাদামাটা সাদা পোশাকে সেন্ট পিটার্স মহাগির্জার বারান্দায় এসে দাঁড়ান। পোপ ফ্রান্সিস জাঁকজমক আর আড়ম্বরের চেয়ে বিনয়কে প্রাধান্য দিতেন। তিনি পোপের জন্য নির্ধারিত লিমুজিন গাড়ি ব্যবহারের চেয়ে অন্য কার্ডিনালদের সঙ্গে বাসে করে বাড়ি ফিরতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ পছন্দ করতেন। তবে এবার নতুন পোপ কেমন হবে তা নিয়ে শুরু হয়েছে চর্চা।
পরবর্তী পোপ নির্বাচন ও কনক্লেভ
পোপ ফ্রান্সিসের মৃত্যুর পর তাঁর উত্তরসূরি নির্বাচন করতে হবে ভোটাভুটি – যা কনক্লেভ বা একান্ত বৈঠক নামে পরিচিত। কয়েক শতাব্দী ধরে চলে আসা এক জটিল প্রক্রিয়া মেনে অতিগোপনে নতুন পোপ নির্বাচন করা হয়। ‘কনক্লেভ’ শব্দটির উৎপত্তি লাতিন “cum clave” থেকে, যার অর্থ “চাবিসহ”—অর্থাৎ কার্ডিনালরা বাইরের বিশ্বের সঙ্গে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে তালাবদ্ধ অবস্থায় থাকেন যতক্ষণ না তাঁরা একমত হন। চার্চের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের একটি দল, যাঁরা পোপ দ্বারা নিযুক্ত তাঁরা ভ্যাটিকানে সমবেত হবেন।কনক্লেভে তাঁরা গোপনে নতুন পোপ নির্বাচন করবেন।প্রায় ১৩৫ জন কার্ডিনাল, যাঁদের মধ্যে ২১ জনকে পোপ ফ্রান্সিস গত ডিসেম্বরেই নিযুক্ত করেছিলেন, এই নির্বাচনে ভোট দেবেন।জানা যাচ্ছে প্রায় দুই সপ্তাহের মধ্যে নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ৮০ বছরের কম বয়সী কার্ডিনালরা শিগগিরই ভ্যাটিকান সিটিতে যাবেন।
পোপ নির্বাচন হয় কীভাবে?
পোপ নির্বাচনে শুধুমাত্র ৮০ বছরের নিচের কার্ডিনালরাই ভোট দিতে পারেন।বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১৩৫ জন। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সিস্টিন চ্যাপেল, ভ্যাটিকানে। কনক্লেভ চলাকালীন কোনো ফোন, ইন্টারনেট, বাইরের যোগাযোগ থাকে না। প্রতিটি কার্ডিনাল গোপন ব্যালটে তাঁদের পছন্দের প্রার্থীর নাম লেখেন। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই কেউ নির্বাচিত হন। প্রতিটি ভোটপর্বের শেষে ব্যালট পুড়িয়ে দেওয়া হয়।এক্ষেত্রে কালো ধোঁয়া বের হলে মানা হয় যে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। আর সাদা ধোঁয়া মানে নতুন পোপ নির্বাচিত।
এবার যিনি নির্বাচিত হন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করবেন কি না। তিনি সম্মত হলে একটি পোপ নাম গ্রহণ করেন এবং সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ব্যালকনি থেকে তাঁকে বিশ্বের সামনে ঘোষণা করা হয় যে ইনি আমাদের পোপ হয়েছেন।
এবারের সম্ভাব্য পরবর্তী পোপ প্রার্থীরা
১. পিয়েত্রো পারোলিন (ইতালি)
বর্তমান ভ্যাটিকান সেক্রেটারি অফ স্টেট। কূটনৈতিক দক্ষতায় দক্ষ এবং চার্চের স্থিতিশীলতার প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
২. রেমন্ড লিও বার্ক ( মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
৭৬ বছর বয়সী প্রাক্তন সেন্ট লুইস-এর আর্চবিশপ। পোপ ফ্রান্সিসের সমালোচক, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তা। ২০১৪ সালে বলেছিলেন চার্চ “একটি দিকভ্রান্ত জাহাজে” পরিণত হয়েছে।
৩. মাত্তেও জুপ্পি (ইতালি)
৬৯ বছর বয়সী, ইতালীয় বিশপ সম্মেলনের সভাপতি। মানবিক সহানুভূতি ও কূটনীতিতে সক্রিয়। ইউক্রেনে শান্তি মিশনের জন্য প্রশংসিত।
৪. পিটার টার্কসন (ঘানা)
৭৬ বছর বয়সী। ২০১৩ সালের কনক্লেভে ছিলেন শীর্ষ প্রার্থী। পরিবেশ ও সামাজিক ন্যায়বিচারে সক্রিয়। নির্বাচিত হলে হবেন আধুনিক ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ পোপ।
৫. লুইস ট্যাগলে (ফিলিপাইন)
৬৭ বছর বয়সী, এভাঞ্জেলাইজেশন সংস্থার প্রধান ও ম্যানিলার প্রাক্তন আর্চবিশপ। অন্তর্ভুক্তিমূলক ধর্মতত্ত্বের প্রবক্তা, চার্চের প্রগতিশীল অংশের পছন্দ।
৬. পিটার এর্ডো (হাঙ্গেরি)
৭২ বছর বয়সী, এস্টারগোম-বুদাপেস্টের আর্চবিশপ। চার্চের ঐতিহ্যবাহী ধ্যানধারণার দিকে ফেরার পক্ষে।
৭. মাইকোলা বিচক (ইউক্রেন)
৪৫ বছর বয়সী, মেলবোর্নের “সেন্টস পিটার অ্যান্ড পল” এর বিশপ। ইউক্রেন যুদ্ধ ও মানবাধিকার ইস্যুতে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন।তিনিই হতে পারেন সবচেয়ে কনিষ্ঠ পোপ প্রার্থী।
গোটা বিশ্বের খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা মনে করে এই নির্বাচন শুধু একজন ধর্মীয় নেতার নির্বাচন নয়,এটি ক্যাথলিক চার্চের ভবিষ্যৎ দিকের ও নির্দেশ দেয়।কে নতুন পোপ নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করা বেশ কঠিন। নতুন পোপ বিশ্বের কোটি কোটি ক্যাথলিকের আস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করবেন এটাই মনে করা হয়।