ফ্যাশন বললেই যে নামটি প্রথমেই মনে আসে তা হল, ‘প্রাডা’। ইতালির এই লাক্সারি ফ্যাশন ব্র্যান্ড এ বার জড়িয়ে পড়ল বড় বিতর্কে। প্রাডার র্যাম্পে দেখা গেল কোলাপুরি চপ্পল। কিন্তু কোথাও উল্লেখ নেই এই চপ্পলের ভারতীয় উৎসের কথা। মিলান ফ্যাশন উইকে প্রাডার স্প্রিং সামার ২০২৬ শো-তে অন্তত সাতটি লুকে মডেলরা পরেছিলেন ভারতের ঐতিহ্যবাহী কোলাপুরি চপ্পল। বাদামি রঙের, টি-স্ট্র্যাপ ডিজাইনের এই চপ্পলগুলিতে ছিল সূক্ষ্ম কারুকাজ। পার্থক্য শুধু একটাই, পাশে বড় করে লেখা ‘প্রাডা’। অথচ শো-নোটে একবারও ‘কোলাপুরি’ নামটি উচ্চারণ করা হয়নি।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের ঐতিহ্য দেখে ফ্যাশনপ্রেমীদের একাংশ খুশি। অন্য দিকে, অনেকেই একে দেখছেন ‘সাংস্কৃতিক অপপ্রয়োগ’ হিসেবে। কারণ কোলাপুরি চপ্পল কোনও নতুন ডিজাইন নয়, বরং ভারতের মহারাষ্ট্র ও কর্নাটকের শতাব্দীপ্রাচীন হস্তশিল্প। ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, ১২ শতকে বিজাপুরে রাজা বিজ্জলের শাসনকালে বসবেশ্বর নামক সমাজসংস্কারক চর্মকার সম্প্রদায়কে সম্মান জানিয়েছিলেন। তখন থেকেই এই চপ্পলের যাত্রা। পরে ২০ শতকে কোলাপুর শহরের নাম অনুসারে এর নামকরণ হয় ‘কোলাপুরি চপ্পল’। ২০১৯ সালে এই চপ্পল পেয়েছে জিআই ট্যাগ। মহারাষ্ট্রের কোলাপুর, সাংলি, সোলাপুর, সাতারা এবং কর্ণাটকের বেলগাঁও, বিজাপুর, ধারওয়াড় ও বাগলকোট এই চপ্পলের উৎপত্তিস্থল হিসেবে স্বীকৃত। কোলাপুরি চপ্পল তৈরি হয় হাতে, প্রাকৃতিক উপায়ে ট্যান করা চামড়া ব্যবহার করে। একটি আসল কোলাপুরি চপ্পল তৈরি হতে সময় লাগে ১০ থেকে ১৫ দিন। চার থেকে পাঁচ জন দক্ষ শ্রমিকের পরিশ্রমের ফল এক একটি চপ্পল।
ডিজাইনার অপরাজিতা তূর বলেন, “আসল বিলাসিতা কেবল কী পরছেন তা নয়, কে বানিয়েছে, কোথা থেকে এসেছে, এবং কেন তা মূল্যবান, সেটাও জানা দরকার।” আর ‘আর্টিমেন’ ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সুকৃত খান্না মনে করেন, যদি প্রাডা ভারতীয় কারিগরদের সঙ্গে কাজ করত এবং স্বীকৃতি দিত, তাহলে তা হত গর্বের বিষয়। কিন্তু কৃতিত্ব ছাড়া এই উপস্থাপনাকে তিনি এক প্রকার অপমান হিসেবেই দেখছেন।
তবে বাস্তব হল, নিজের দেশেই এখন সঙ্কটে কোলাপুরি চপ্পল শিল্প। কোলাপুর ও আশপাশের গ্রামগুলোতে এখনকার যুবসমাজ আর এই পরিশ্রমসাধ্য কাজে আসতে চায় না। বরং তারা খুঁজছে সচ্ছল চাকরি। অধিকাংশই প্রবীণ ব্যক্তিরা এই কাজ করছেন, কেউ কেউ ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক।
‘শপকপ’ ব্র্যান্ডের কর্ণধার রাহুল পরসূ কাম্বলে বলেন, “একটা আসল কোলাপুরি বানাতে ভেজিটেবল ট্যানড লেদার ব্যবহার করতে হয়, যার প্রস্তুতিতে সময় লাগে তিন থেকে চার মাস। অথচ আজকাল রাসায়নিক চামড়া বা সিন্থেটিক দিয়ে বানানো হয় ১০–১৫ দিনেই, কিন্তু তার গুণগত মান কম এবং ত্বকে সমস্যা হতে পারে”। প্রত্যেকটি চপ্পলের দাম পড়ে ১৫০০ থেকে ৩০০০ টাকার মধ্যে। অথচ বাজার ভরে গেছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার নকল পণ্যে। এগুলো তৈরি হয় গ্লু আর মেশিনে। ফলে ক্রেতারা বারে বারে সস্তা নকল কিনে নেন, আর মূল কারিগররা পিছিয়ে পড়েন। রাহুল জানান, তিনি নিজেই নতুন কারিগরদের প্রশিক্ষণ দেন। সরকার ও সমাজের কাছে তাঁর অনুরোধ, এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে আরও সহযোগিতা যেন করা হয়। আন্তর্জাতিক র্যাম্পে কোলাপুরি চপ্পলের উপস্থিতি মানে দেশের গর্ব। কিন্তু সেই কোলাপরি চপ্পলের উৎসবে অস্বীকার করে শুধুমাত্র ফ্যাশন স্টেটমেন্টকে বড় করে দেখা তা অনুচিত। কারণ, কোলাপুরি চপ্পল শুধু পায়ের জুতো নয়, এটা এক সংস্কৃতি।