সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়
রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের ডিএ বা মহার্ঘভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টে যে আর্থিক সংকটের কথা জানিয়ে আবেদন করেছে রাজ্য তা একটি সরকারি কৌশল মাত্র। এমনটাই দাবি ডিএ সংক্রান্ত মামলার মূল আবেদনকারীদের। এমনকি যে ছয় মাসের সময় মেয়াদ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়েছে রাজ্যের পক্ষ থেকে সেক্ষেত্রেও একটি বিশেষ কৌশল রয়েছে বলে দাবি। মূলত মামলাকারী রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের সংগঠন কনফেডারেশন অফ টেট গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ ফেডারেশনের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের জেরে বকেয়া ডিএ দিতে রাজ্য সরকার যে মোট টাকার হিসেব দেখিয়েছে অর্থাৎ ৪১,৭৭০.৯৫ কোটি টাকার হিসেবে গরমিল রয়েছে। তবুও তর্কের খাতিরে এই টাকার অংককে সঠিক ধরে নিলেও সম্পূর্ণ ১০০ শতাংশ একবারে দেওয়া সম্ভব না হলেও অধিকাংশ বকেয়ায় মিটিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে রাজ্য সরকারের কাছে। ফেডারেশনের দাবি, ২০১১-১২ আর্থিক বছর থেকে ২০২১-২২ আর্থিক বছর পর্যন্ত অর্থাৎ মোট ১০ বছরের সময়কালে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বেতন পেনশন খাতে যে বাজেট বরাদ্দ করেছে রাজ্য সরকার তার মধ্যে ২৫ হাজার ২৬২ কোটি টাকা খরচ করাই হয়নি। এছাড়াও কেন্দ্রীয় অর্থ কমিশনের বরাদ্দের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা খরচ করেনি রাজ্য সরকার। অর্থাৎ সবমিলিয়ে রাজ্যের কোষাগারে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বেতন ও পেনশন বাবদ বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা পড়ে রয়েছে। যে টাকায় রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের মোট বকেয়া ডিএ-র ৭৫ শতাংশ মিটিয়ে দেওয়া সম্ভব। সে ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে জুন মাসের মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ বকেয়া ডিএ মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। “সদিচ্ছা থাকলে রাজ্য সরকারের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পালন করতে কোন অসুবিধা থাকার কথা নয়” মন্তব্য মামলাকারী কর্মী সংগঠনের সভাপতি শ্যামল কুমার মিত্রের। শ্যামলবাবু আরও জানিয়েছেন, “সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ যথেষ্ট আশা সঞ্চার করলেও আদালতের নির্দেশেই প্রকাশ্যে আসা ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ এবং সেই সুপারিশকে ঢাল করে সুপ্রিম কোর্টের রাজ্য সরকারের আর্থিক সংকটের প্রসঙ্গ টেনে ৬ মাসের সময় চাওয়া নতুন করে ভাবনা বাড়িয়েছে।”
এই ভাবনা বা দুরাশার নেপথ্যের কারণটা অবশ্য আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত। আদালতে যারা মামলা মোকদ্দমার সঙ্গে জড়িত তারা অন্তত এটুকু জানেন যে আইনি লড়াইতে সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে আদালতের বেঞ্চের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। পঞ্চম বেতন কমিশন ও রোপা-২০০৯ এর বিরোধিতা করে রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের করা মামলায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে রায় দেয় স্টেট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনাল অথবা স্যাট। রাজ্য কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে হাইকোর্ট ও স্যাট-এর নির্দেশ বহাল রাখে। রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ বা মহার্ঘভাতা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয় এই কারণ দেখিয়ে রাজ্য সরকার ফের সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়। ২০২২ সালের ২৮ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টে এই মামলার প্রথম শুনানি হয়। এরপর ১৮ বার একাধিক বেঞ্চে এই মামলার শুনানি পিছিয়ে যায়। ট্রাইবুনাল ও কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের পরও বছরের পর বছর ডিএ মামলা সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে থাকে। অবশেষে গত ১৬ মে বিচারপতি সঞ্জয় কারণ ও বিচারপতি সন্দীপ মেহেতার বেঞ্চ মাত্র ১৩ মিনিটের শুনানিতে রাজ্য সরকারকে সরকারি কর্মীদের বকেয়া বেতনের ২৫ শতাংশ ছয় সপ্তাহের মধ্যে মিটিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রশ্ন উঠছে এখান থেকেই। যদি মাত্র ১৩ মিনিটের শুনানিতে রায়দান করা যায় তাহলে মামলাটি দিনের পর দিন কেন সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে ছিল? এখানেই বেঞ্চ বদলের ভাবনা গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আর ঠিক সে কারণেই ষষ্ঠ বেতন কমিশনের সুপারিশ ও রাজ্যের আর্থিক দৈন্যতার কথা তুলে ধরে এবং বকেয়া ডিএ দিতে বাজার থেকে ঋণ সংগ্রহ ও ঋণ নেওয়ার পদ্ধতিগত সময়ের উল্লেখ করে সুপ্রিম কোর্টে রাজ্য সরকার ৬ মাসে সময় চেয়েছে। কারণ দিনের পর দিন ঝুলে থাকা যে মামলাটি মাত্র ১৩ মিনিটে শুনানিতে যে বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছে সেই বেঞ্চকে এড়িয়ে যাতে অন্য বেঞ্চে মামলাটি স্থানান্তরিত হয় সে কারণেই এই সময় চেয়ে নেওয়া হয়েছে বলে মনে করছেন মামলাকারীরা। মামলাকারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মলয় কুমার মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “রাজ্য সরকারের হাতে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ পালনের জন্য প্রয়োজনীয় টাকা থাকার কথা। তবুও রাজ্য সরকার কৌশলগত কারণেই কোশাগাড়ের শূন্যতার কথা উল্লেখ করছে এবং বাজার থেকে ঋণ নিতে হবে এই ধরণের অজুহাত দিচ্ছে। আসলে আরও কিছুটা সময় ব্যয় করে পরিস্থিতির জল মাপতে চাইছে রাজ্য সরকার।” এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। ৬ মাসের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই রাজ্যে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বাজবে। ফলে সময় খরচের তালিকাটা আরেকটু বাড়াতে পারলেই নির্বাচনী নির্ঘণ্ট প্রকাশের সময় উপস্থিত হবে। পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্য সরকার ডিএ বাবদ খরচের হাত থেকে রেহাই পাবে। রাজ্যের এই কৌশলগত অভিসন্ধি অমূলক নয় বলেও মনে করছে সরকারি কর্মীমহল। যদিও রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বকেয়া ডিএ পাওয়া নিয়ে দীর্ঘদিনের আন্দোলন বিফলে যাবে না বলে মনে করছেন মামলাকারীরা।