বিচারহীন আরজি করের পরিণতি কসবা
এই বাংলায় এখন ধর্ষণ একটা অপরাধ নয়! এটা একপ্রকার ছাড়পত্রপ্রাপ্ত ‘দলীয় ইনসেনটিভ’। সাদা অ্যাপ্রোনে থাকা মেয়েরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরছে হাসপাতালের ভেতরে, ইউনিয়ন রুমে ছাত্রীরা আতঙ্কে চুপ করে যাচ্ছে, আর সরকার চুপ করে বসে আছে, যেন কিছুই হয়নি। একদল ছাত্রনেতা ‘রাজনীতির নামে ধর্ষণ’ নামক একটি নতুন কোর্স শুরু করেছে, যেখানে মেয়েদের গায়ে হাত দেওয়া হল ‘লিডারশিপ স্কিল’। হ্যাঁ, এটাই এখন বাংলার কলেজ ক্যাম্পাস। আর আরজি কর মেডিক্যাল কলেজে যে মৃত্যুর উৎসব শুরু হয়েছিল, তার সোজা ফল আজ দেখা গেল কসবায়। যখন একজন ধর্ষক জানে, তার পরিচয় ‘দলের ছেলে’, তখন তার সাহস বেড়ে যায়, তার হাতে আইন না থাকলেও থাকে সরকারি ছাতা, প্রশাসনিক চুপচাপি, আর এক দল নীরব ভোটব্যাংক শ্রোতা।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের সেমিনার হল, যেখানে একজন ডাক্তার ছাত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়, আজও বাংলার রাষ্ট্রশক্তির এক অন্ধকার প্রহর হয়ে রয়েছে। সেই মৃতদেহের পাশে দাঁড়িয়ে নীরব ছিল হাসপাতাল, লাপাত্তা ছিল সিসিটিভি, নীরব ছিল পুলিশ, আর মুখে কুলুপ এঁটেছিল সরকার। এই নীরবতাই জন্ম দিয়েছে আরও এক বর্বর অধ্যায়, যা আমরা দেখতে পাচ্ছি কসবা ল কলেজে।
সত্যি কথা বলতে কী, আরজি করের ধর্ষণ ও খুনের ঘটনার যদি প্রকৃত বিচার হতো, যদি সরকার এবং প্রশাসন প্রথম থেকেই রাষ্ট্রীয় বার্তা দিত যে ‘এই বাংলায় ধর্ষণ করলে দলীয় পরিচয় কিছুই নয়’, তাহলে কসবা কলেজের সেই অভিযুক্ত TMCP ছাত্রনেতা, কোনও ছাত্রীকে প্রকাশ্যে স্পর্শ করার আগে একশোবার ভাবত।
কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টোটা। আরজি কর কাণ্ডে অভিযুক্ত সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়, যাকে প্রশাসনের ভেতরের যোগসাজশ ছাড়া কোনওদিন এতটা ক্ষমতা পেত না, তাকে গ্রেফতার করা হলেও সরকার নীরব থাকে। মুখ্যমন্ত্রী কোনো বিবৃতি দেন না। তদন্তের নামে চলে ধামাচাপা। এমনকি CBI এসে সরাসরি বলে, “গ্যাং-রেপ নয়”! এটা কি তদন্ত, না শাসকদলের ভাবমূর্তি রক্ষার নাটক?
এই প্রশ্রয়, এই দায়হীনতা, এই দলানুগত বিচারব্যবস্থাই এক TMCP ছাত্রনেতাকে সাহস জুগিয়েছে, এক কলেজের ইউনিয়ন রুমে প্রকাশ্যে একজন ছাত্রীকে শ্লীলতাহানি করার। তার বিরুদ্ধে আগেও একাধিক অভিযোগ ছিল, তবুও কলেজ প্রশাসন নিশ্চুপ। কারণ সে ‘দলের ছেলে’। বাংলায় এখন ধর্ষণ অপরাধ নয়, রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের ‘ধাপ’।
এই ছাত্রনেতা হয়তো জানে, সঞ্জয় রায়র মতো ধর্ষকরাও বেঁচে যায়। তাই কলেজে ছাত্রীকে স্পর্শ করার সাহস জন্মায়। কারণ সে দেখে, এই রাজ্যে ‘দল’ থাকলে, আইন কিছু করে না। আর সরকার যদি প্রথম অপরাধকে আড়াল করে, তাহলে পরবর্তী অপরাধীরা উৎসাহ পায়।
বলাবাহুল্য, কসবা কাণ্ড কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা আরজি কর কাণ্ডের প্রত্যক্ষ ফলাফল। এই ‘দলীয় অপরাধের বিচারহীনতা’ই একটার পর একটা ধর্ষণের জন্ম দিচ্ছে।
ধর্ষকদের বিচার না করে সরকার যদি বারবার নিরব থাকে, তা হলে এ রাজ্যে হাসপাতাল, কলেজ, স্কুল, কোনও জায়গাই নারীর জন্য নিরাপদ থাকবে না। কারণ ধর্ষণ এখন দলীয় সংস্কৃতি, আর প্রশাসন হল তার চুপচাপ প্রযোজক।
তাই আজ শুধু TMCP নেতার বিচার চাই না। চাই সেই প্রশাসনের বিচারের কাঠগড়া, যারা সঞ্জয় রায়কে বাঁচিয়েছে, এবং যার ছায়াতলে কসবার ছাত্রনেতা মেয়েদের গায়ে হাত তোলার সাহস পেয়েছে।
এ রাজ্যে যদি ধর্ষকের পরিচয় আগে ‘দলের ছেলে’ হয়, আর পরে ‘অপরাধী’, তাহলে বাংলার প্রতিটি মেয়ে আজ শুধু ধর্ষণের ‘পরবর্তী কাস্টিং’।