কণাদ মুখার্জি
বছর একুশ আগের কথা। অ্যান্টিগার সেন্ট জন্স স্টেডিয়ামে এপ্রিলের রোদ। শুধু গনগনে রোদেই নয়, দশক দুই আগের সেই এপ্রিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়ে ব্রায়ান লারার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের আঁচেও পুড়ে ছাই হয়েছিল মাইকেল ভনের নেতৃত্বাধীন ইংরেজ ক্রিকেট টিম। ৭৭৮ মিনিট ধরে ব্যাট করে ৫৮২ বল খেলে লারার রান ৪০০। তিনি তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের ক্যাপ্টেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানে অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং, কলিন ক্রফট এবং জোয়েল গার্নার, এই ফোর হর্সমেনের ঝোড়ো গতি ও সুইংয়ের সামনে বিপক্ষের নুয়ে পড়া। এর পর, ভিভিয়ান রিচার্ডস, গর্ডন গ্রিনিজ, ডেসমন্ড হেইন্স ও ক্লাইভ লয়েডের মোক্ষম আঘাতে প্রতিদ্বন্দ্বীর মাটিতে মিশে যাওয়া। একটা সময় পর্যন্ত ক্রিকেট দুনিয়া এই দাপট দেখতেই অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু লারা ক্যাপ্টেন হওয়ার কিছুটা আগেই ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সেই স্বর্ণযুগ অস্তাচলে। বস্তুত লারা যখন ক্যাপ্টেন তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ তার পুরনো গরিমাকেই শয়নে-স্বপনে দেখছে। সেই পর্বেই ব্রিটিশ বোলিংকে শাসন করে লারা নতুন রূপকথা লিখেছিলেন টেস্ট ক্রিকেটে। তৈরি করেছিলেন ৪০০ রানের নতুন পাহাড় চূড়া।
কে আর জানত, সেই ঘটনার ২১ বছর বাদে ক্রিকেটে আবির্ভাব হবে নতুন নায়কের! লারার রূপকথাকে বেষ্টন করেই তিনি তুলি চালাবেন নাম না জানা সব রঙে। আঁকবেন নতুন ছবি! স্পর্শ করবেন আরও একটা নতুন চূড়া।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
২০০৪ সালের অ্যান্টিগায় লারা যখন ব্রিটিশ বোলাদের ত্রাস হয়ে উঠেছেন তখন এখনকার দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্যান্ড ইন ক্যাপ্টেন পিটার উইলেম আদ্রিয়ান মুল্ডার বছর ছয়েকের বালক মাত্র। ইংল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক মাইকেল আর্থারটন দাবি করেছেন, তাঁর ৪০০ রানের রেকর্ড কে ভাঙবে, এই প্রশ্নের উত্তরে দু’জন ব্যাটসম্যানের নাম জানিয়েছিলেন ব্রায়ান চার্লস লারা। আর্থারটনের বক্তব্য, তালিকায় ছিলেন ভারতের যশস্বী জয়সওয়াল ও ইংরেজ ক্রিকেটার হ্যারি ব্রুক। ধারেকাছে ছিলেন না মুল্ডার।
কিন্তু গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার স্ট্যান্ড ইন ক্যাপ্টেন মুল্ডার। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ৩৬৭ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। ক্রিকেট দুনিয়া তখন ভাবতে শুরু করেছিল ২১ বছর ধরে অক্ষত থাকা লারার রেকর্ডকে এ বার ছাপিয়ে যাবেন মুল্ডার। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে মুছে দিয়ে নতুন কীর্তি গড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ক্যাপ্টেন। অপরাজিত ৩৬৭ রানে ইনিংস ডিক্লেয়ার করে লারার রেকর্ড থেকে ৩৪ রান দূরে থেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন মুল্ডার। ঠিক যেমনটা করেছিলেন মার্ক টেলর। টেস্টে স্যর ডন ব্র্যাডম্যানের সর্বাধিক রান ৩৩৪। ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান সফরে গিয়ে পেশোয়ারে ৩৩৪ রানে অপরাজিত থাকাকালীন ডিক্লেয়ার করে দিয়েছিলেন টেলর। ক্ষমতা থাকলেও হিমালয়কে পেরিয়ে যেতে চাননি তিনি। টেলরের মতো প্রথার বাইরে গিয়ে লারার উচ্চতাকে পেরোলেন না মুল্ডারও।
আরও পড়ুন
মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ২২ গজে উঠে আসা মুল্ডারের। ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট ও রাগবি খেলার প্রতি প্রবল আগ্রহ। অনূর্ধ্ব উনিশ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সদস্য ছিলেন। জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েও বাদ পড়েছিলেন। তার পর প্রত্যাবর্তন। বর্ণবৈষম্যের জেরে বিশ্ব ক্রিকেটে দীর্ঘ দিন নিষিদ্ধ ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেই পর্ব পেরিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে চমকপ্রদ উত্থান সত্ত্বেও বার বার চূড়ান্ত পর্বে ধাক্কা খাওয়া অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। শেষ পর্যন্ত চোকার্স তকমা সরিয়ে লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টেম্বা বাভুমার দল। লারাকে অতিক্রম না করে এ হেন দক্ষিণ আফ্রিকার মুকুটে আরও একটি পালক জুড়ে দিলেন মুল্ডার।
১৯৮৭-র বিশ্বকাপে লাহোরের গদ্দাফি স্টেডিয়ামে পাকিস্তান বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ২১৬ রান তাড়া করছিল পাকিস্তান। শেষ বলে ২ রানের দরকার ছিল। কোর্টনি ওয়ালশ ডেলিভারি করার আগেই নন স্ট্রাইকিং এন্ড থেকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন পাক বোলার সেলিম জাফর। ওয়ালশ ম্যানকাডিং করে আউট করতে পারতেন জাফরকে।
কিন্তু তিনি বল না করে ক্রিজে ফিরিয়ে আনেন জাফরকে। এর পর অবশ্য ম্যাচ হেরে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ছিটকে যায় টুর্নামেন্ট থেকেই। সেই প্রথম বিশ্বকাপের সেমি ফাইনালে উঠতে ব্যর্থ হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ক্রিকেট জীবনে বিশ্বকাপ জেতা হয়নি কোর্টনি ওয়ালশের। কিন্তু গোটা ক্রিকেট দুনিয়া তাঁকে স্মরণে রেখেছে ১৯৮৭ সালে গদ্দাফি স্টেডিয়ামের ওই ঘটনার জন্য। জীবনের প্রতিটি ঘটনায় ভাল বা মন্দ এই দুই উত্তর খুঁজতে থাকা আমাদের মন এই ঘটনাকে কী ভাবে ব্যাখ্যা করবে? আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত না কি, হেরে গিয়েও বাজিগর হয়ে যাওয়া?
কিছু দিন আগেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বোলিং করার সময় বাবর আজমকে বল ছুড়ে বিতর্ক বাধিয়েছিলেন মুল্ডার। তখন তাঁর মুণ্ডপাত করেছিলেন অনেকে। আবার এখন মুল্ডারের সেই মাথাতেই উঠেছে মুকুট।
আরও পড়ুন
জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে জয় দেখতে চাই আমরা। পুরনো সব কিছু ভেঙে নতুন নতুন রেকর্ড গড়তে চাই। প্রতিবেশীর সন্তান ৯৫ শতাংশ নম্বর পেলে, আমার সন্তানকে ৯৬ শতাংশ নম্বর আনার জন্য তাতাতে থাকি। একই কথা খাটে বেতনের ক্ষেত্রেও। নতুন নতুন উচ্চতা গড়াই যে দুনিয়ায় দস্তুর, সেখানে মুল্ডার ভিন্গ্রহের জীব। দেশ-কাল বা দ্বেষের বাধা পেরিয়ে তিনি এই পৃথিবীতে ঢুকে পড়েছেন মার্ক টেলর বা কোর্টনি ওয়ালশের মতোই। তবে আশার কথা, লারাকে পেরিয়ে যাওয়ার আগে মুল্ডারের এই থেমে যাওয়ার উদাহরণ শুধু ক্রিকেট নয়, আমাদের জীবনকেও এগিয়ে দেবে আরও কয়েক ধাপ। মুল্ডার যে পথে এই লেনদেনের দুনিয়ায় ঢুকে নতুন রেকর্ড তৈরি করলেন, ভবিষ্যতে সেই পথের সন্ধান পাবেন আরও অনেকে। ক্রিকেটের মধ্যে আসলে মানুষের জীবনের এই ব্যাপ্তিকেই আবিষ্কার করে ফেলেছেন।
মুল্ডারের বক্তব্য, ৪০০ রানের রেকর্ড ব্রায়ান লারারই থাক। সেই রেকর্ড তিনি গ্রাস করতে চান না। এটাও জানান যে, ভবিষ্যতে তিনি ৪০০ রানের কাছাকাছি পৌঁছলেও, লারার রেকর্ড ভাঙবেন না। ক্রিকেটকে যুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করতে ভালবাসতেন লারা স্বয়ং। সেই যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়েই মুল্ডার স্মরণ করালেন, বাম মনোভাবাপন্ন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লেখক সিএলআর জেমসের উক্তি, “তারা ক্রিকেটের কী-ই বা বোঝে, যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে!”