অভিজিৎ বসু
রাজনীতিতে সব সম্ভব। যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে ঘাড় ধরে আর বন্দুকের ট্রিগার টিপে, জমি নিয়ে আন্দোলন করে রাজ্য থেকে সিঙ্গুরের তিন ফসলি জমি থেকে টাটাকে বিদায় দেবার পর। আবার সেই টাটাকেই স্বাগত জানিয়ে নবান্নে আমন্ত্রণ করা। চা, জল আর মিষ্টি খেতে দিয়ে এই বার্তা দেওয়া শিল্পক্ষেত্রে বাংলাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর এই পশ্চিমবঙ্গ সরকার। নবান্নে টাটা সনস্ এবং টাটা গ্রুপের চেয়ারম্যান এন. চন্দ্রশেখরণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই বার্তাই দিলেন। আশা করাই যায়, এই আলোচনা ভবিষ্যতের শিল্প বিনিয়োগে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে চলেছে।
বেশ ভালই লাগে এই শিল্প বাণিজ্য মেলা আর বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে দেখলে এই বঙ্গ রাজ্যে। শিল্প নিয়ে একদিন আজ থেকে বছর কুড়ি আগে এই সরকারের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যে ভূমিকা পালন করতে আমরা দেখি সেটার কথা মনে পড়লেই কেমন হাসি পায় আমার আজকাল। সেই সিঙ্গুরের ফাঁকা মাঠ। সিঙ্গুরের তিন ফসলি জমি। সবুজ ধান এর ক্ষেত। সব কিছুর দখলদার লাল পার্টির সিপিএম আর তার লেঠেল বাহিনীর সদস্যরা। তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো কিছু তৃণমুল নেতা কর্মীদের উপস্থিতি তাদের প্রিয় দিদির দলের হয়ে লড়াই করা।
জাজবাত বাংলায় আরও পড়ুন
সেই সিঙ্গুরের ফাঁকা মাঠে মঞ্চ বেঁধে আন্দোলন। আর গান গেয়ে বক্তৃতা করে হাততালি দিয়ে জোর করে জমি দখলের বিরুদ্ধে লড়াই করে সিপিএমের এই দখলদারির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সবুজ মাঠে নেমে পড়া। সেই সিঙ্গুরের জমিতে টাটাদের কারখানা তৈরি করার পর শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে উৎখাত করা, সেই সময়ের লড়াই করা কিছু তৃণমূলের একনিষ্ঠ ক্যাডার এর দিদির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। হাসি মুখে সিপিএমের পুলিশের বিরুদ্ধে লড়াই করা কোনো কিছুতেই ভয় না পেয়ে।
সেই হুগলী জেলার ডাকাবুকো তরুণ তাজা ছেলে দিলীপ যাদবের বাইরে থেকে কাজ করতে আসা শ্রমিকদের ভয় দেখিয়ে আর স্লোগান দিয়ে এখান থেকে এই জেলা থেকে চলে যাও বলে জানান দেওয়া কঠিন মুখে আর বেশ সিরিয়াস ভাব নিয়ে। এই সবটাই যে রাজনীতির খেলা। যে রাজনীতিতে সেই আমলের প্রথম সারির অনেক নেতাই আজ বেশ কোণঠাসা। আর আজ ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে একটু নড়েচড়ে নবান্নের সেই চোদ্দ তলায় বসে সাদরে হাসি মুখে টাটাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ডেকে এনে বলা, আমি শিল্প দরদী আর শিল্পের বন্ধু সরকার। যে সরকার শুধুই মা মাটি আর মানুষের জন্যে সরকার নয়।
শিল্পের জন্য বন্ধু সরকার। আর সেই এক সময়ের জনপ্রিয় শিল্প বিরোধী হয়ে সরকার এর হঠাৎ করেই এই বন্ধু হয়ে ভোল বদলে ফেলা। এটা বেশ ভালো ব্যাপার কিন্তু। এই ঘাড় ধরে বন্দুক উঁচিয়ে জমি আন্দোলন করে নিজের রাজনৈতিক মাইলেজ পেতে রাজ্য থেকে বের করে দেওয়া বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠী টাটাকে। আবার সেই এক সংস্থাকেই নিজের বিরোধী ইমেজ একটু ‘এডিট’ করে মুছে দিয়ে তাঁদের সাদরে বরণ করে নেওয়া। সেই বিখ্যাত উক্তি প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর, এমন তো কতই হয় সেই কথাই মনে পড়ে গেলো আমার।
আরও পড়ুন
রাজনীতির ময়দানে ঘুরে বেড়ানো মানুষজন যাঁরা অন্য এক নক্ষত্র খচিত জগতে বিচরণ করেন তাঁদের কাছে এটা নতুন কিছুই নয়। শিল্প বাণিজ্য বিরোধী ভূমিকা থেকে শিল্পের বন্ধু হয়ে যাওয়া এক ভালো বন্ধুর ভূমিকা পালন করা বা গ্রহণ করা। পরপর তিনবার ক্ষমতা দখল করে থাকার পর এটা আর নতুন কী এমন হতেই পারে। যা নিয়ে আমি এতো ভাবছি।
শুধু সেই আজ থেকে বেশ ক বছর আগের চিত্র, সেই লাঠি, গুলি, আন্দোলন, মিছিল আর মিটিং এই সবের মাঝে সেই বাংলার অগ্নিকন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী বনে যাওয়া। আর তাঁর শিল্প বিরোধী থেকে শিল্পের বন্ধু হয়ে যাওয়া। সত্যিই অসাধারণ এই বদলে যাওয়া। যা নিয়ে আমরা এত ভাবলেও যাঁকে নিয়ে এতো ভাবনা চিন্তা তাঁর এইসব নিয়ে কোনোও ভাবনাই নেই। তিনি এখন যে শিল্পের বন্ধু, শত্রু নন।