দিব্যেন্দু ঘোষ
আমার বাড়ি থেকে কতই বা দূর। বাইকে কুড়ি-পঁচিশ মিনিট। জগৎবল্লভপুরের গোহালপোতা গ্রাম। বছরের দুটো দিন ওখানে যাওয়া চাই-ই চাই। ৩ সেপ্টেম্বর ও ২৪ জুলাই। ছুঁয়ে দেখি পথঘাট, গাছ, সবুজ ঘাস। এই পৃথিবীর অধম মানুষ আমি, ওই দুটো দিন বড্ড উত্তম হতে ইচ্ছে করে। জানি, ওই ছায়ামাখা পথে ইতিহাস হয়ে আছে গাড়ির দাগ, ওই ঘাসে তাঁর বৈকালিক চরণ আলো হয়ে ফুটে আছে, ওই ঘাটে শ্যাওলা ছুঁয়ে দেখি, স্মৃতি হয়ে লেপ্টে আছে উত্তম কিছু ঘ্রাণ, বুক ভরে শ্বাস নিই, ওই গাছে পাতা ঝরে গেছে, শীতে টুপটাপ শিশির পড়ে, গ্রীষ্মে রোদ ঝুঁকে আসে, দু-চারটে কাক, শালিক, ঘুঘুর আলস্য-মাখা বিশ্রামের গায়ে অনেক গল্প জমে আছে। চোখ খুলে দেখি, দৃষ্টি প্রসারিত করি, মেঘ করে আসে, হালকা হাওয়া, পুরনো যা কিছু, ডানা মেলে, এক বিষণ্ণ চুরুটের গন্ধ ভিড় করে আসে, গ্রামজুড়ে সব কেমন ‘উত্তম’ অনুভব, অধমেরকোথাও কিচ্ছু থাকে না, থাকতে পারে না।
আমি হাঁটি, পাতা ঝরে যাওয়া গাছের গায়ে হেলান দিয়ে সবুজ দেখি, ঘাসের বুকে গা এলিয়ে দিই, ইতিহাস ধীর লয়ে হেঁটে আসে, পুকুরে কচুরিপানা সরিয়ে ভেসে থাকে এক স্বপ্ন-মানুষ, যেন গেয়ে ওঠে, ‘দেখুক পাড়া পড়শিতে, কেমন মাছ গেঁথেছি বঁড়শিতে…’, আমি ঘাটে বসে চুপটি করে চেয়ে থাকি, অতীতের বিবর্ণ হয়ে আসা পাতারা উত্তরের হাওয়ায় পতপত করে খুলে যায়, হলুদ রঙের সেই সব পাতায় গল্প জড়িয়ে থাকে, যে গল্পের যাপন আমার সত্তায় প্রসারিত হয়, চোখ বুজলেই যেন দেখতে পাই, এ পৃথিবীতে কিছুই অধম নেই আর, সব কেমন উত্তমে রূপান্তরিত।
এ গ্রাম যে উত্তমের গ্রাম। গর্ব করি, এই জেলায় জন্ম, বেড়ে ওঠা আমার, এই জেলারই এক গ্রাম আপন করে নেয় মহানায়ককে, যখন আসতেন তিনি, মনে হত যেন এ তাঁর দ্বিতীয় ঘর, ঠিক তেমন করেই তাঁকে আপন করে নিয়েছে, প্রিয় আসনে বসিয়ে রেখেছে, কোনওদিন সে যত্নে ধুলোবালি জমতে দেবে না গোহালপোতা। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও পরিবেশন সংস্থা চণ্ডীমাতা ফিল্মসের কর্ণধার প্রয়াত সত্যনারায়ণ খাঁয়ের বাড়ির দরজা তাঁর জন্য আজীবন খোলা। গেট, সিঁড়ি, বারান্দা, খাট বিছানা, রেলিং, কড়িবরগা, দেওয়ালে এখনও লেগে আছে উত্তম গন্ধ। হাত দিলেই মনে হয়, সেই মানুষটাকে ছুঁয়ে আছি, রক্তমাংসের মানুষটা এই বুঝি বারান্দায় আরামকেদারায় বসে খবেরর কাগজের পাতায় চোখ বোলাচ্ছেন কিংবা খাটে দুধসাদা বালিশে আধশোয়া হয়ে ‘ঘরে বাইরে’ পড়ছেন। কালজয়ী একাধিক ছবির শুটিং তো এই বাড়িতেই হয়েছে, এই গ্রামে, ওই মাঠে, সেই পুকুরে, রাস্তায়। এখনও ধুলোবালিতে লেগে আছে ‘সন্ন্যাসী রাজা’র ঘোড়ার ক্ষুরের স্পর্শ, ওই পুকুরের জলে লেগে আছে তার শরীরের ছোঁয়া।
চণ্ডীমাতা ফিল্মসের কর্ণধার ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সত্যনারায়ণ খাঁয়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত সখ্য ছিল উত্তমকুমারের। সেই সূত্রেই চণ্ডীমাতা ফিল্মসের একাধিক সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্র ছিলেন উত্তমকুমার এবং সেই সব ছবির অনেক দৃশ্যের শুটিং হয় এই গোহালপোতায়। এই গ্রামের মাঠ, গাছপালা, নদীর ছবি তোলা রয়েছে ‘ধন্যি মেয়ে’, ‘সন্ন্যাসী রাজা’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘কমললতা’, ‘হার মানা হার’, ‘অপরিচিত’, ‘বনপলাশীর পদাবলি’র মতো বহু ছবিতে। উত্তমবাবুর থাকার জন্যই গোহালপোতায় এই বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেছিলেন সত্যনারায়ণবাবু। যে তিনতলা বাড়িতে ফাইভ স্টার হোটেলের মতো সুবিধা। টানা তিরিশ বছর এই বাড়িতে এসে়ছেন মহানায়ক। শেষ বার এসেছিলেন ১৯৮০ সালে ‘প্রতিশোধ’ ছবির শ্যুটিং করতে। বেশিরভাগ সময়ে অভিনয়ের চিন্তায় বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি। ডাকলে মনে হত হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠলেন। এই গ্রাম এখনও যেন বাঁচে উত্তমকুমারকে ঘিরেই। প্রবীণরা ভুলতে পারেন না গ্রামের রাস্তায় মহানায়কের প্রাতর্ভ্রমণ, শুটিংয়ের ফাঁকে স্কুলের অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়া, কত কী!
আজ তাঁর ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী। এখনও জগৎবল্লভপুরের গোহালপোতার প্রবীণ মানুষদের কাছে অমলিন তাঁর স্মৃতি। তবে সত্যনারায়ণবাবুর বাড়িটি দেখে মন খারাপ হয়ে গেল। ভগ্নদশা। তিনতলার দক্ষিণ দিকের বারান্দা যুক্ত ঘরটিতে থাকতেন মহানায়ক। ওই ঘরটা উত্তমের ঘর হিসাবেই পরিচিত আজও। একটি বড় রেডিয়ো ছিল সত্যনারায়ণবাবুর। সেই রেডিয়োতে মন দিয়ে খবর শুনতেন উত্তমকুমার। গ্রামবাসীরা বেশির ভাগই চাষাবাদে যুক্ত। মহিলারাও নিতান্তই ছাপোষা। কিন্তু মহানায়কের নাম শুনলেই সকলে এখনও কপালে হাত ঠেকান। দিনের পর দিন তাঁকে কাছ থেকে দেখার স্মৃতি হাতড়ান। অসামান্য আভিজাত্য, কিন্তু মনটা ছিল সমুদ্রের মতো বড়।
১৯৮০ সালে ‘প্রতিশোধ’ ছবির শুটিং করতে এসেছিলেন। এখনও গ্রামের অনেকেই মনে করতে পারেন। ওই বছরেই ২৪ জুলাই তিনি চলে যান অযুত নক্ষত্রের দেশে। অবসর সময়ে কিংবা মন খারাপ হলেই কলকাতা ছেড়ে গ্রামের এই বাড়িতেই চলে আসতেন মহানায়ক। আত্মজীবনী ‘আমার আমি’-তে এই ঘরের উল্লেখ করে গেছেন উত্তম। শেষবারের মতো তিনি এসেছিলেন মৃত্যুর কয়েক দিন আগে। মহানায়ক জানিয়েছিলেন শরীর ভালো নেই, এ বাড়িতে ঘুরতে এসেছিলেন মন ভালো করতে। শহুরে মনকে আকৃষ্ট করার মতোই যে এই গ্রাম। গ্রামের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে কানা দামোদর। নদীর গায়ে যেন হেলান দিয়ে থাকে সবুজ ধানের খেত, কাঁচা মাটির রাস্তা। সে এক নৈসর্গিক দৃশ্য।
‘প্রতিশোধ’ ছবির শুটিং সেরে কলকাতায় ফেরার কিছুদিনের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন উত্তমকুমার। শ্রাবণের এক বৃষ্টিমুখর দিনে উত্তমহারা হয় বাংলা। তাঁর প্রয়াণে কেঁদেছিল আপামর বাঙালি। তাঁর সেই ভুবনভোলানো হাসি, চোখের চাহনি, নারী-মনে তুফান তোলা আবেগ এখনও যেন চুঁইয়ে পড়ে গোহালপোতার প্রান্তরে। আজও তিনি রোম্যান্টিসিজমের শেষ কথা। ১৯৮০ সালের সেই ২৪ জুলাই আসার কিছু বছর আগে থেকেই শ্বাসের সমস্যায় ভুগছিলেন। হাসপাতালে প্রায়ই চিকিৎসার জন্য যেতেন। ডাঃ সুনীল সেনকে বারবার বলতেন, ‘আমাকে বাঁচান’। চিকিৎসকরা তাঁকে বারবার জীবনযাত্রার ধরন বদলানোর জন্য বলতেন। নিয়মিত ওষুধ খেতেন। কিন্তু, ভাগ্যের লিখন কেই বা খণ্ডাতে পারেন। ২৩ জুলাই ১৯৮০। সলিল দত্ত পরিচালিত ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-র শেষ দিনের শুটিং চলছিল তখন। শেষ দৃশ্যের শুটিংয়ের সময়ই হাতটা বুকে চলে যায় উত্তম কুমারের। তখনই হার্ট অ্যাটাক হয়। কিন্তু তিনি বুঝতে দেননি। ঠিক ওভাবেই বুকে হাত রেখে এমনভাবে অভিনয় করেন যে, ধরতে পারেনি কেউ। যাঁর একচিলতে হাসি লক্ষ নারীর হৃদয়ে তুফান তুলত, তখন সেই মানুষটার হৃদয়জুড়ে তোলপাড়। শুটিং সেট থেকেই উত্তম কুমারকে নিয়ে যাওয়া হয় বেলভিউ নার্সিংহোমে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিন বার হার্ট অ্যাটাক হয় তাঁর। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে চিকিৎসক সুনীল সেনের হাত ধরে কাতর কণ্ঠে উত্তম কুমার বারবার অনুরোধ করেছিলেন, ‘আমাকে বাঁচান’। শত চেষ্টা করেও কথা রাখতে পারেননি কেউ। একরাশ অভিমান বুকে নিয়ে চলে যান মহানায়ক, মাত্র ৫৪ বছর বয়সেই। ২৪ জুলাই গিরিশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে নিয়ে আসা হয় দেহ। চোখের জলে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে যেন গোটা বাংলা ছুটে এসেছিল। মহানায়কের প্রতি আবেগ আর ভালবাসা দেখেছিল বাংলা। জনতার স্রোত দেখেছিল বাংলা। জনতার সমুদ্র আটকাতে পুলিস হিমশিম খায়। সমুদ্রকে কি আটকানো যায়?
অদ্ভুত এক কাজ করেছিলেন উত্তমকুমার। ডায়েরিতে নিজের মৃত্যুদিনের আগে থেকেই দাগ দিয়ে রেখেছিলেন। মহানায়ক তাঁর সঙ্গে সব সময় একটা ডায়েরি রাখতেন। নিজেই সেখানে লিখে রাখতেন সিনেমার শুটিংয়ের ডেট। হয়তে ভাবতে পেরেছিলেন কিংবা টের পেয়েছিলেন মহানায়ক নিজেই যে, তার চলে যাওয়ার সময় এগিয়ে আসছে। সেই ইঙ্গিতই পাওয়া যায় তাঁর ডায়েরির পাতায়। অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা, ১৯৮০ সালের ডায়েরিতে জুলাই মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত সবকিছু লিখে রাখলেও, উত্তম বাদ দিয়েছিলেন ২৪ জুলাই পাতাটি! ২৫ জুলাই শুধু লেখা ছিল ‘বাঞ্ছারামের বাগান’। আর তা লিখলেও, পরে কলমের এক দাগে তা কেটে দিয়েছিলেন। ২৬ জুলাইয়ের পর থেকে বেশ কয়েকটি পাতায় উত্তম আগে থেকেই লিখে রেখেছিলেন, ‘বিশ্রাম’, ‘চিরবিশ্রাম’ এই দুই শব্দ। কেন হঠাৎ এভাবে বিশ্রামের কথা লিখেছিলেন উত্তম? টের পেয়েছিলেন কি মৃত্যুর! সে রহস্য নিয়েই মহানায়কের মহাপ্রস্থান। আর উত্তমের সেই ডায়েরির পাতা আজও রহস্যঘেরা সংকেত বয়ে চলে।
সেই মহানায়কের গ্রামকে আজ দেখলে কেমন যেন মনখারাপ ঘিরে ধরে। আজও যেন এক অজ পাড়াগাঁ। সিনেমাপ্রেমী অনেক বাঙালিই এই গ্রামের পরিচয় জানেন না। সত্যনারায়ণবাবুর মৃত্যুর পরে তাঁদের ব্যবসায় কিছুটা ভাটা পড়ে। মারা যান তাঁর দুই ছেলেও। বন্ধ হয়ে যায় ‘চণ্ডীমাতা ফিল্মস’। তবে সেই বাড়ি আজও উত্তম স্মৃতিকে বুকে আগলে নিয়ে চলেছে। ‘ধন্যি মেয়ে’র সেই ফুটবল মাঠ। যেখানে উত্তমকুমার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পরিচালনা করেছিলেন ফুটবল খেলা। সিনেমার সেই হাড়ভাঙা গ্রাম, অর্থাৎ গোহালপোতার কিছু কিছু জায়গায় এখনও রয়ে গেছে মার্টিন ট্রেনের চিহ্ন। যে ট্রেনে করে কলকাতা থেকে এই গ্রামে এসেছিলেন ফুটবলাররা। ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল’ গানের দৃশ্যগ্রহণ হয়েছিল। গ্রামের অনেক বয়স্ক মানুষই সেদিন ছিলেন খুব ছোট। সেদিনের সেই ফুটবল খেলায় মাঠে দর্শক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। তাদের স্মৃতিতে এখনও ভাসে ‘ধন্যি মেয়ে’র বিখ্যাত সেই ফুটবল ম্যাচ। সুখেন দাসের সেই ধারাবিবরণী। সে সব স্মৃতি এখানও আনাচ কানাচে ছড়ানো। সত্যনারায়ণবাবুর সেই বাড়ি এখন জীর্ণ। দেখভালের জন্য বংশধরেরা সেখানে ভাড়াটিয়া বসিয়েছেন। গোহালপোতার বুক চিরে বয়ে গেছে কানা দামোদর বা কৌশিকী নদ। নৌকায় যেতে যেতে মহানায়কের লিপে ‘বনপলাশীর পদাবলি’র সেই বিখ্যাত গান ‘ভোলা মন আমার…’-এর শুটিং হয়েছিল এই নদেই। হাওড়া জেলা পরিষদ পর্যটনের পরিকল্পনা করছে এই গ্রাম ঘিরে। গ্রামীণ হাসপাতালের পিছনেই সেই মাঠ, যেখানে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির ফুটবল খেলার শুটিং হয়েছিল। মাঠটি চিহ্নিত করা হবে। মাঠের ধারে ‘ডিসপ্লে বোর্ড’ দিয়ে ‘ধন্যি মেয়ে’-র সেই ফুটবল খেলার দৃশ্য তুলে ধরার পরিকল্পনা। মহানায়কের থাকার জন্য যে বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল, তার সামনেই তোলা হয়েছিল ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে জনতার গেট ভেঙে রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ার দৃশ্য। চিহ্নিত করা হবে সেই জায়গাটিও।