শার্লি এবদো… ল্য মোঁদ… লেস ইকোস… হারা কিরি… কাগজ আছে, কাগজ, টাটকা খবর, হাতে গরম খবর… যুদ্ধ শেষ, ক্ষমা চাইলেন পুতিন… ট্রাম্পের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন পুতিন…
পরনে জিন্স, ফুলশার্ট, চোখে চশমা, মাথায় কালো টুপি, তাঁর হাঁক শুনে প্যারিস সেন্ট জার্মেইয়ের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে পড়ল একটা ভিড়। আবালবৃদ্ধবনিতা, এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। ‘আমায় একটা ল্য মোঁদ দিন তো’, ‘আমায় একটা লেস ইকোস’। কেউ বলে উঠলেন, ‘আরে আকবর ভাই, আসুন, এক কাপ কফি খেয়ে যান’। রেস্তোরাঁর ভিতর থেকে হাত উঁচিয়ে কেউ যেন বলে উঠল, ‘আকবর, টুডে হ্যাভ আ লাঞ্চ উইথ মি’।
অনাবিল দুপুর গড়িয়ে চলেছে বিকেলের দিকে, টুপটুপ ঝরছে মন খারাপের বিষণ্ণ রোদ, পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে অভ্যস্ত ব্যস্ততা, প্রিয় আকাশ চিঠি পাঠিয়েছে গতকাল বিকেলে, এ বছর প্যারিসে রেকর্ডভাঙা তুষারপাত, তামাক ফুরিয়ে গেছে, আনতে পারেনি সে, এই প্রথম, অনেকটা সময় নিয়ে ভুলেছিল তামাকের গন্ধ। রাতের প্যারিস এখন নিয়নের স্নিগ্ধতা ছেড়ে নিয়েছে উৎকট সোডিয়ামের সজ্জা। ইউরোপের মানচিত্র এখন রুটি হয়ে গেছে, খিদে পেলেই ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাও, স্বাধীনতা মানেই যেন উদরপূর্তি। পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ বোধহয় ভুলে থাকা, স্মৃতি থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য সুদীর্ঘ প্রবাসের অর্ধেকটা কাটিয়েছে বোহেমিয়ানদের মতো ঘুরে ঘুরে। না, ফ্রান্সের শেষ কাগজের ফেরিওয়ালা আলি আকবরের স্মৃতি হেঁটে ফেরে দুঃসহ শৈশবের অলিগলিতে। পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে দশ ভাইবোনের সংসার ঘিরে ছিল চরম দারিদ্র। কখনও আধপেটা, কখনও না-খাওয়া পেটে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে খাবার সংগ্রহ করতে হয়েছে, পড়াশোনা করাটা ওদের কাছে ছিল বাতুলতাই। মাত্র বারো বছর বয়সেই স্কুলছুট। তবুও খোলা নর্দমার পাশে শুয়ে রাত কাটানো, হোটেলে পড়ে থাকা উচ্ছিষ্ট খেয়েও এর-তার বই চেয়ে পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়া আকবরের।
প্যারিসের ফুটপাথ কিংবা কোনও রেস্টুরেন্টের দাওয়ায় বসে শূন্যে তাকিয়ে থাকা চোখে বলে যান আকবর, ‘দুঃখ দিয়ে বোনা পোশাক পরতে চাইনি, লোকের আনুগত্যে বাঁচতে চাইনি, মায়ের কষ্ট মেটাতে একটা বাগানওয়ালা বাড়ি দিতে চেয়েছি।’ মাত্র আঠারো বছর বয়সেই পাসপোর্ট জোগাড় করেন আকবর। ইউরোপ বলতে জানতেন আইফেল টাওয়ার আর ডাচ টিউলিপ। ১৯৭০-এ বাসে চেপে কাবুল, তারপর পায়ে হেঁটে, মাঝে কিছুটা লিফট চেয়ে নেওয়া কোনও গাড়িতে ইরান। শেষমেশ এথেন্স পৌঁছে যাওয়া। জাহাজে কাজ মিলল। মুসলিম, তাই মদ ছুঁয়েও দেখেন না, আর তা নিয়েই জাহাজের সহকর্মীদের ঠাট্টা, মশকরার নিত্য শিকার আকবর। জাহাজের চাকরি ছেড়ে ফের রাওয়ালপিন্ডি ফিরে আসা। সেখানে কিছুদিন এটা সেটা কাজ করে ফের ইউরোপ পাড়ি। বুকে স্বপ্ন আঁকড়ে পথ হাঁটেন আকবর, মাকে কষ্টের জীবন থেকে মুক্তি দেওয়াই একমাত্র লক্ষ্য। গ্রিসে ভিসা সমস্যা, সেখান থেকে বিতাড়িত হয়ে ফের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া। আবার উদ্যম নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। এবার গন্তব্য ফ্রান্স, সেটা ১৯৭৩ সাল, প্যারিসের একটা রেস্টুরেন্টে চাকরি জুটিয়ে নেওয়া। রাতে ব্রিজের নীচে শোওয়া, পরিশ্রমের একতরফা জীবন। উল্টে বর্ণবিদ্বেষের শিকার। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই।
১৯৭৪-এ জীবনের মোড় ঘুরে গেল আলি আকবরের। এক আর্জেন্টিনীয় ছাত্রের সঙ্গে পরিচয়, যে পড়াশোনার পাশাপাশি কাগজ ফেরি করে। তার সাহায্যেই ‘শার্লি এবদো’ ও ‘হারা-কিরি’ পত্রিকা নিয়ে প্যারিসের রাস্তায় হকারি। ফুটপাথ ধরে হেঁটে যান, পথচলতি মানুষকে পত্রিকা বিক্রি করেন, কখনও রেস্তোরাঁয় ঢুকে হাতে তুলে দেন পত্রিকা। মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালবাসেন, তাদের মজার মজার গল্প শোনান, হাসি-ঠাট্টার মধ্যেই কাগজ বিক্রি করেন। সেটাই আকবরের ইউএসপি। প্যারিসের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে লাগলেন আলি আকবর। দুপুর থেকে মধ্যরাত, পত্রিকা ফেরি করেন। তাকে একদিন না দেখতে পেলে অনেকেই খোঁজখবর শুরু করে দেন।
টিভি, স্মার্ট ফোন, ডিজিটাল, সোশাল মিডিয়ার দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। ছাপাখানার অস্ফূট আর্তনাদ, কাগজের অফিসের আনাচ-কানাচে মনখারাপের বাতাস, একের পর এক কাগজ, সাপ্তাহিক পত্রিকার ঝাঁপ পড়ে যাওয়া, আকবর আলির জীবন ফের কঠিনতর হয়ে ওঠা। তবুও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। ৫১ বছর ধরে প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় কাগজ ফেরি করে চলেছেন আলি আকবর, হাসিমুখে, লড়াইকে সম্বল করে। বুদ্ধিজীবী, অভিনেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বাস প্যারিস সেন্ট জার্মেইতে। প্রভাবশালীদের সঙ্গে পরিচয়, সখ্য। ফ্রান্সের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ফঁসোয়া মিতেরঁ, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন, ব্রিটিশ-ফরাসি অভিনেত্রী, গায়ক এবং ডিজাইনার জেন বিরকিন, লেখক বার্নার্ড হেনরি লেভি আকবরকে চিনতেন, জানতেন, এক অদ্ভুত ভাললাগা ছিল। তাঁদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে উপকার পেয়েছেন। পাকিস্তানের এক মেয়ের সঙ্গে ১৯৮০-তে বিয়ে। পাঁচ ছেলে আকবরের। এক সন্তান অটিস্টিক, একজন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন, জন্মের পরেই একজনের মৃত্যু। জীবন সহজ নয় আকবরের। তবুও মানুষকে হাসাতে হাসাতে, জোকস বলতে বলতে কাগজ ফেরি করে চলেছেন। কিন্তু পৃথিবী তাঁকে কাঁদিয়েই চলেছে। জীবনে সুখ খুব কমই দেখেছেন। নিজের মুখেই বলেন। তবুও তার আফসোস নেই, মাকে তো একটা বাগানওয়ালা বাড়ি দিতে পেরেছেন পাকিস্তানে। সেটাই আকবরের জীবনে সবথেকে বড় সুখ।
বদলে যাওয়ার কষ্টের অপর নাম স্মৃতি, এখন তাই নিয়ে বুঝি মেতে আছে আকবর, এই ৭৩ বছর বয়সেও। এই পরবাসে বদলে যেতে দেখেছেন কত সুদৃঢ় ইতিহাস, বালির বাঁধের মতো ভেসে গেল পূর্ব ইউরোপ, নদীর পাড় ভাঙার মতো ভেঙে গেল বার্লিন প্রাচীর, ইংলিশ চ্যানেলের তল দিয়ে হুইসেল বাজিয়ে চলছে ট্রেন, মাদ্রিদ থেকে হামবুর্গ, নিউক্যাসল নেপোলি থেকে প্রাগ, বুখারেস্ট মেসিডোনিয়া, নর্থ সি থেকে মেডিটেরিয়ান কিংবা ব্ল্যাক সি, তবু আকবর বাঁচতে পারেনি স্মৃতি থেকে। প্যারিস বইমেলায় নতুন বইয়ের গন্ধে মনে পড়েছে তাঁর শৈশব, সিসিলির কার্নিভ্যালে, এথেন্সের কফিশপের জমজমাট কবিতাপাঠের আসরে মনে পড়েছে মাকে, তার কষ্টের শিশুকাল, তাই মাঝে মাঝে প্যারিসের তারাজ্বলা আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রিয় কবির কবিতা পড়েন আকবর। প্যারিস খুলে দিয়েছে তাঁর আত্মার চোখ, সঙ্গীত আর শিল্পের অভিন্ন সুর শুনেছেন প্যারিসে। কনসার্টে যতবার মোৎসার্ট কিংবা বিটোভেন শুনেছেন, ততবারই কেন যেন চিরদুখী পাগল ভিনসেন্ট ভ্যানগগের কথা মনে পড়েছে। সমস্ত প্যারিসের রাস্তায়, গ্যালারিতে, ফেস্টিভ্যালে খুঁজে ফিরেছেন ভিনসেন্টের কষ্ট। অগণিত শিল্পীর কষ্ট থেকে প্যারিস পেয়েছে সৌন্দর্য; কষ্টই প্যারিসের ঐশ্বর্য। স্বপ্নের প্যারিসে আজ নিজেকে একা মনে হয় না আকবরের। পরিবর্তনের দমকা হাওয়ায় ফ্রান্সের শেষ কাগজের ফেরিওয়ালা বদলায়নি এতটুকু।
সেই আকবর আলিকেই দেশের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান দিচ্ছে ফ্রান্স। সেপ্টেম্বরে আকবরের হাতে লিজিয়ঁ দ’নর তুলে দেবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। এই সম্মানে এর আগে ভূষিত হয়েছেন কিলিয়ান এমবাপে, সত্যজিৎ রায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, লেডি রাণু মুখোপাধ্যায়। আকবর, তোমার যাত্রা অব্যাহত থাকুক, বাইজেনটাইন সম্রাজ্ঞীর মতো তোমাকে ঘিরে থাক পৃথিবীর সমস্ত সুখ, তুমি অনিন্দ সুন্দর হয়ে ওঠো তোমার সৃষ্টিতে, তুমি ভালো থেকো।
Leave a comment
Leave a comment