আফ্রিকার আর পাঁচটা দেশের সঙ্গে কোনও ফারাক নেই সেনেগালের। আফ্রিকার অন্য দেশগুলির মতোই পুরুষপ্রধান সমাজ সেনেগালে। এই দেশে সমাজে বদল আনতে রাষ্ট্রসংঘের উদ্যোগে শুরু হয়েছে এক বিশেষ স্কুল। যার নাম ‘স্কুল ফর হাসব্যান্ড'( School for Husband)। এই স্কুলেই পড়ান ইমাম ইব্রাহিম ডায়ান। যেহেতু পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাই এখানে বাড়ির যাবতীয় কাজ সামলান মহিলারা। গৃহস্থালির কাজে পুরুষদের আরও বেশি সাহায্য করা উচিত, ক্লাসে সে কথাই বোঝাচ্ছিলেন ইব্রাহিম। তাঁর সেই কথা শুনে অনেকে যেমন হেসেছিলেন, তেমনই অনেকেই আবার হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিচ্ছিলেন।
ক্লাসে ইব্রাহিম তাঁর ছাত্রদের বলছিলেন, যে পুরুষ তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে কোনওরকম সাহায্য করে না সে আদৌ ভালো মুসলিম নয়। স্বয়ং নবীজি এই কথা বলে গিয়েছেন। একইসঙ্গে ইব্রাহিম দাবি করেন, তিনি বাড়িতে তাঁর স্ত্রীকে বিভিন্ন কাজে সাহায্য করেন। ছেলেমেয়েদের স্নান করিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করে দেন।
আফ্রিকার অন্য দেশগুলির মতো সেনেগালেও পুরুষরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারী। এমনকি, পরিবার পরিকল্পনা-সহ জীবনের যে কোনও বড় ধরনের সিদ্ধান্তে মেয়েদের কোনও মতামতই নেওয়া হয় না। সেদেশে মেয়েদের একান্ত ব্যক্তিগত কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রেও পুরুষদের অনুমতি নিতে হয়। সমাজের চলতি ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতেই সেদেশে চালু হয়েছে ‘স্কুল ফর হাসব্যান্ড’ নামের এই বিশেষ স্কুল। যার লক্ষ্য হল, সমাজের পুরুষ সদস্যদের মধ্যে স্বাস্থ্য, সমাজ, অর্থনীতি সম্পর্কে ইতিবাচক মানসিকতা জাগিয়ে তোলা।
ইব্রাহিম জানিয়েছেন, তিনি প্রজনন সংক্রান্ত বিষয় ছাড়াও লিঙ্গ বৈষম্যের ব্যাপারেও পুরুষদের সচেতন করার কাজ করেন। আলোচনা করেন এইচআইভির মতো সংক্রামক রোগ নিয়েও।
ইব্রাহিমের দাবি, অনেক মহিলাই তাঁকে জানিয়েছেন তাঁর এই স্কুলে পড়ে তাঁদের স্বামীদের চরিত্রে এবং আচরণে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে তাঁরা বাড়ির কাজে যথেষ্ট সাহায্য করছেন। বেশ কয়েকজন পুরুষও নিজেদের এই পরিবর্তনের কথা মেনে নিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন বর্তমানে বাড়িতেও তাঁরা স্ত্রী ও শিশুদের জন্য অনেকটাই সময় দেন। বিভিন্ন কাজে স্ত্রীকে সাহায্য করেন।
হাবিব ডিয়ালো নামে এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, তিনি ইমামের ক্লাস করে যথেষ্টই উপকৃত হয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন, বাড়িতে সন্তানের জন্মদান কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাঁর ছেলের বউ যখন অন্তঃসত্ত্বা ছিল তখন তাদের তিনি হাসপাতালে পাঠাতে উৎসাহিত করেছিলেন। ছেলে প্রথমে আপত্তি করলেও শেষ পর্যন্ত বিষয়টি বুঝতে পেরেছিল।
২০১১ সালে সেনেগালে
এই কর্মসূচি শুরু করে রাষ্ট্রসংঘ। সম্প্রতি সে দেশের নারী ও শিশু কল্যাণ মন্ত্রকও বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হয়েছে। মাতৃত্বকালীন মৃত্যু এবং শিশু মৃত্যুর হার কমাতে এই স্কুলের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বলে মেনে নিয়েছে সেই দেশের নারী ও শিশু কল্যাণমন্ত্রক।
তবে শুধু সেনেগাল নয়, আফ্রিকার নাইজার, বুরকিনা ফাসো, কঙ্গো, টোগোর মতো একাধিক দেশে রাষ্ট্রসংঘের এই ‘স্কুল ফর হাসব্যান্ড’ কর্মসূচী চলছে। দীর্ঘদিন ধরে এই কর্মসূচি চলার ফলে আফ্রিকার এই দেশগুলিতে নারী ও শিশু স্বাস্থ্যের অনেকটাই উন্নতি হয়েছে বলে দাবি।
জানা গিয়েছে, সেনেগালে এই ধরনের প্রায় ২০ টি স্কুল রয়েছে। যেখানে ৩০০ -রও বেশি পুরুষ প্রশিক্ষিত হয়েছেন। বর্তমানে ওই সমস্ত পুরুষরাও বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে ক্লাস নিচ্ছেন।
খাড়ি নডেয়ে নামে এক মহিলা জানিয়েছেন, তাঁর স্বামী আগে বাড়িতে কোনও কাজই করতেন না। কিন্তু বর্তমানে তাঁর স্বামী রান্না করা থেকে শুরু করে বাড়ির অনেক কাজই করেন। সবই স্কুল ফর হাসব্যান্ডের সুফল।
২০২৩ সালেও দেখা গিয়েছে আফ্রিকার দেশগুলিতে একলাখ শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ২৩৭ জন মা মারা গিয়েছেন।অন্যদিকে প্রতি এক হাজার শিশুর মধ্যে জন্মের এক মাসের মধ্যেই ২১ জন মারা গিয়েছে।
তাই রাষ্ট্রসংঘর লক্ষ্য হল, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি ১ লাখ শিশুর বিপরীতে মাতৃমৃত্যুর সংখ্যা ৭০ জনের নিচে নামিয়ে আনা। একইভাবে নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি এক হাজারে ১২-র নিচে নামিয়ে আনা। সেই লক্ষ্যপূরণে বিভিন্ন কর্মসূচিও নিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ।
সেনেগালে রাষ্ট্রসংঘের এই কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা হাদিজ মালিক বলেছেন, এখনও এই দেশে অধিকাংশ শিশুর জন্ম হয় বাড়িতে। সে কারণেই শিশু মৃত্যু বা সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মেয়েদের মৃত্যুর সংখ্যা অনেক বেশি। তবে বর্তমানে পুরুষদের শিক্ষার ফলে নারীদের গর্ভকালীন সময়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া এবং হাসপাতালে সন্তানের জন্মদানের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। পাশাপাশি পুরুষরা এখন অনেকেই গৃহস্থালির কাজেও এগিয়ে এসেছেন। তবে পুরুষদের মানসিক অবস্থার পুরোপুরি পরিবর্তন করতে আরও কিছুটা সময় লাগবে।