দুই বছরেরও বেশি সময় পর জম্মু ও কাশ্মীরের এক কনস্টেবলকে হেফাজতে নির্মম নির্যাতনের অভিযোগে ছয় পুলিশ আধিকারিককে গ্রেফতার করল সিবিআই এর বিশেষ তদন্তকারী দল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে গত মাসে এই বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করে সিবিআই। ডিসপি সুভাষ চন্দ্রের নেতৃত্বে গঠিত এই দল কনস্টেবল খুরশিদ আহমেদ চৌহানের নির্যাতনের মামলা খতিয়ে দেখে।
গ্রেফতার হওয়া অভিযুক্তরা হলেন, ডিএসপি আইজাজ আহমেদ নাইকু, সাব-ইন্সপেক্টর রিয়াজ আহমেদ এবং কনস্টেবল ইমতিয়াজ আহমেদ, হাজাগনির আহমেদ, শাকির আহমেদ ও মহম্মদ ইউনুস। তদন্ত চলাকালীন জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের গ্রেফতার করা হয় এবং বর্তমানে তারা শ্রীনগরের এক জেলে বন্দি রয়েছেন।
গত ২১ জুলাই সিবিআই-কে অভিযুক্তদের গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। মিলেছিল ভুক্তভোগীর পরিবারকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার রায়। কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে এভাবে প্রকাশ্যে ব্যবস্থা নেওয়া বিরল ঘটনা বলেই মনে করা হচ্ছে।
ঘটনাটি ঘটে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সূত্রের খবর বারামুল্লা জেলা পুলিশ লাইনে কর্মরত কনস্টেবল চৌহানকে ডিএসপি নাইকু নির্দেশ দেন কুপওয়ারার এসএসপি-র দফতরে হাজির হতে। সেখানে তাকে পরবর্তীতে জেলার জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেন্টারে স্থানান্তর করা হয়।
অভিযোগ অনুযায়ী, টানা ছয় দিন ধরে চৌহানকে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। আদালতের নথি বলছে, তার দুই অণ্ডকোষ অপারেশনের মাধ্যমে কেটে ফেলে দেওয়া হয় এবং তার মলদ্বারে জোর করে উদ্ভিজ্জ বস্তু ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নির্যাতনের জেরে চৌহান কোমায় চলে যান। কিন্তু কুপওয়ারা পুলিশ দাবি করে, চৌহান নিজেই শিরায় ব্লেড চালিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এরপর তার বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির আত্মহত্যার চেষ্টা ৩০৯ ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের করা হয়।
কিন্তু যখন চৌহানের স্ত্রী রুবিনা আখতার তথ্যের অধিকার আইনের মাধ্যমে চিকিৎসা পরীক্ষার রিপোর্ট সংগ্রহ করেন। ওই রিপোর্টে ধরা পড়ে ভয়াবহ চিত্র। তারপরেই কেস ঘুরে নয়।
রিপোর্টে ছিল, অণ্ডকোষ সম্পূর্ণ কেটে ফেলা, নিতম্ব থেকে উরু পর্যন্ত গুরুতর আঘাতের চিহ্ন, হাতের তালু ও পায়ের পাতায় ভোঁতা আঘাতের প্রমাণ, মলদ্বারে উদ্ভিজ্জ কণিকার উপস্থিতি, শরীরের বিভিন্ন স্থানে একাধিক ফ্র্যাকচার।
সুপ্রিম কোর্ট আখতারের দায়ের করা মামলার শুনানিতে বলে, এই ঘটনা “আমাদের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে।” আদালত জানায়, ২০২৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি চৌহানকে যখন হাসপাতালে আনা হয়, তখন এক সাব-ইন্সপেক্টর তার বিচ্ছিন্ন যৌনাঙ্গ একটি প্লাস্টিক ব্যাগে করে নিয়ে আসে।
বিচারপতি বিক্রম নাথ এবং সন্দীপ মেহতা পর্যবেক্ষণে বলেন, পুলিশ তদন্তে “পদ্ধতিগত গোপন করা ও ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রবণতা” স্পষ্ট হয়েছে। তারা মন্তব্য করেন, “এই মামলার নজিরবিহীন ভয়াবহতা, যেখানে হেফাজতে অমানবিক নির্যাতনে ভুক্তভোগীর যৌনাঙ্গ কেটে ফেলার মতো জঘন্য ঘটনা ঘটেছে। দেশের অন্যতম নৃশংস পুলিশি নির্যাতনের ঘটনা হিসেবে সামনে এসেছে এই ঘটনা।” আদালত আরও নির্দেশ দেয়, ৫০ লাখ টাকার ক্ষতিপূরণ অভিযুক্ত পুলিশদের বেতন থেকে কেটে নিতে হবে।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ায় সশস্ত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে জম্মু-কাশ্মীরে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক হেফাজতে নির্যাতন ও অতিরিক্ত হত্যার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু প্রায়শই অভিযুক্তরা আইনের জালে ধরা পড়ে না, বিশেষ করে আর্মড ফোর্সেস স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট-এর মতো আইনের কারণে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানিয়েছে, ১৯৯০ থেকে ১৯৯৪ সালের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে ৭১৫ জন বন্দির মৃত্যু হয়েছিল। এর মধ্যে অনেকে নির্যাতনের ফলে প্রাণ হারান, বাকিদের গুলি করে হত্যা করা হয়।
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীর কোয়ালিশন অফ সিভিল সোসাইটি এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ পেরেন্টস অফ ডিসঅ্যাপিয়ার্ড পারসন্সের রিপোর্টে ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ৪৩২টি হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়। এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ ভুক্তভোগী ছিলেন সাধারণ নাগরিক। এখন কাশ্মীরে হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ও নিহতদের পরিবারকে নতুন করে ন্যায়বিচারের আশা জাগিয়েছে এই মামলা।