রাজা বন্দোপাধ্যায়
কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানভাণ্ডারকে নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে বড় পদক্ষেপ নিল। শুক্রবার প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ও মেশিন লার্নিং (ML) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা বাংলার হাজারো বিরল পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ, পাঠোদ্ধার ও অনুবাদের কাজে হাত দিচ্ছে।
এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো বহু শতাব্দী ধরে সঞ্চিত দুর্লভ পাণ্ডুলিপিগুলিকে ডিজিটাল আকারে সংরক্ষণ, ধ্বংসপ্রায় বা ক্ষতিগ্রস্ত লেখা উদ্ধার, সংকেতলিপি পাঠোদ্ধার ও আধুনিক ভাষায় অনুবাদ।
এর ফলে এই জ্ঞানভাণ্ডার কেবল গবেষক বা পণ্ডিতদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, সাধারণ ছাত্রছাত্রী ও বৃহত্তর জনগণের কাছেও সহজলভ্য হবে।
প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে আইআইটি খড়গপুর, আইআইটি দিল্লি ও সিড্যাক (CDAC)।
সিড্যাক ট্রান্সক্রিপশন প্রক্রিয়ার কাজ করছে। আইআইটি দল তৈরি করছে স্ক্রিপ্ট রিকগনিশন ও অনুবাদের অ্যালগরিদম। ক্ষতিগ্রস্ত পান্ডুলিপির লেখা উদ্ধার করতে ব্যবহার করা হবে হাইপারস্পেকট্রাল ক্যামেরা।
শুক্রবারের বৈঠকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বিশ্বভারতী, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট আর্কাইভস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট ও একাধিক আঞ্চলিক গ্রন্থাগারের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
প্রকল্পের নেতৃত্বে থাকা লেফটেন্যান্ট কর্নেল অনন্ত সিংহ (অ্যাডমিনিস্ট্রেটর, এশিয়াটিক সোসাইটি) বলেন, “আমাদের চেষ্টা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রাচীন জ্ঞানব্যবস্থাকে উন্মুক্ত করা। তার জন্য পাণ্ডুলিপিগুলো সংরক্ষণ ও অনুবাদ করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প নেই।”
জাতীয় গ্রন্থাগারের ডিরেক্টর জেনারেল অজয় প্রতাপ সিংহ ইতিহাসের দৃষ্টান্ত টেনে বলেন, “নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করা হয়েছিল সমাজের জ্ঞানচর্চাকে ছিন্ন করার জন্য। জ্ঞান ধ্বংস করা সবসময় সভ্যতাকে দুর্বল করার অস্ত্র।”
আইআইটি খড়গপুরের প্রাক্তন ডিরেক্টর পার্থ প্রতিম চক্রবর্তীর মতে, “আমাদের প্রাচীন জ্ঞানই প্রকৃত সফট পাওয়ার। সন্তানরা যদি কেবল বাইরের শিক্ষাপদ্ধতিই অনুসরণ করে, তবে সেটাই আরেক ধরনের পরাধীনতা।”
ন্যাশনাল ম্যানুস্ক্রিপ্ট মিশনের ডিরেক্টর অনির্বাণ দাশ বলেন, “আমাদের প্রাচীন জ্ঞানের মাত্র এক শতাংশ পাণ্ডুলিপিতে টিকে আছে। সেগুলো উদ্ধার করতে না পারলে সমাজের জন্য তা হবে এক গভীর ক্ষতি।”
১৭৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এশিয়াটিক সোসাইটি বর্তমানে প্রায় ৫০,০০০-এর বেশি পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করে রেখেছে, যার বড় অংশই এখনও পাঠোদ্ধার হয়নি।
এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ভারতের হারিয়ে যাওয়া জ্ঞান-ঐতিহ্যের এক বিশাল ভাণ্ডার নতুন প্রজন্মের সামনে খুলে যাবে। অতীতের জ্ঞান ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে এশিয়াটিক সোসাইটির এই উদ্যোগ আগামী দিনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে।